Pages

Monday, August 5, 2013

নামাযে কিয়াম অবস্থায় কোথায় হাত রাখা সুন্নাত?

নামাযে কিয়াম অবস্থায় কোথায় হাত রাখা সুন্নাত?

-এস এম ফারুক হাসান

 
নামাযে হাত কোথায় রাখা সুন্নাত, এ ব্যপারে ইমামদের মাঝে মতভেদ আছে। ইমাম শাফেয়ির মতে নাভীর উপরে বুকের নিচে হাত রাখা সুন্নাত এবং এটাই তার বিশুদ্বতম মত। ইমাম মালীকের মতে হাত না বেধে ছেড়ে দেয়া সুন্নাত। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মতে নাভীর উপরে বা নিচে যে কোন এক জায়গায় রাখলে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসূফ, ইয়াম মুহাম্মদ,সুফয়ান সাওরী, ইসহাক ইবনে রাহবিয়াহ এবং আবু ইসহাক মযুরী (শাফেয়ী) এবং অসংখ্যা ফোকায়ে কেরামের মতে নাভীর নিচে হাত বাধা সুন্নাত। (ইলাউস সুনান ২য় খন্ড ১৯১পৃ, মাআরিফুসসুনান ২য় খন্ড ৪৩৬ পৃ)

আমাদের দেশে আহলে হাদিস নামধারি কিছু লোক এ ব্যাপারে অতিরঞ্জিত শুরু করেছে। তারা বলে বুকের উপর হাত বাধা সুন্নত এবং নাভীর নিচে হাত বাধার সবগুলো হাদীস দুর্বল এবং এ ব্যাপারে কোন ছহীহ হাদিস নেই। (ভূমিকা, সালাতে নারী পুরুষের বুকে হাত বাধা)। অথচ নাভীর নিচে হাত বাধা ছহীহ হাদীছ এবং রসূল (সাঃ) এর পবিত্র আমল দ্বারা প্রমাণিত এবং বুকের উপর হাত বাধার দলীল এর চেয়ে নাভীর নিচে হাত বাধার দল অনেক বেশী শক্তিশালী। বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবু তৈয়ব মাদানি তিরমিযি শরীফের ব্যাখা গ্রন্থে বলেন চার ইমামের কোন ইমাম বুকের উপর হাত বাধতে বলেননি। বুকের উপর হাত বাধার হাদীস যদি এতই শক্তিশালী হত, তাহলে কোন না কোন ইমাম বুকের উপর হাত বাধা সুন্নাত বলত। (ফাইযুল বারী শরহে বুখারী ১ম খন্ড ৬১৪পৃ,তানজিমুল আসতাত শরহে মিশকাত ৩০১পৃ, মারেফুস সুনান ২য় খন্ড ৪৩৬, )
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বুকের উপর হাত রাখাকে মাকরুহ মনে করেন (মাসায়েলে আবু দাউদ লিল ইমাম আহমদ (র) ৪৭-৪৮পৃ)
নিম্নে হাদিসের বিশুদ্ব এবং গ্রহণযোগ্য কিতাব সমুহ হতে নাভীর নিচে হাত বাধার হাদিস সমুহ উল্লেখ করা হল।


১নং দলীলঃ

عن ابي حازم عن سهل بن سعد (رض) قال كان ناس يومرون ان يضع الرجل اليد اليمني علي ذراعه اليسري في الصلاة قال ابو حازم لا أعلمه ألا ينمي ذلك الي النبي صلي الله عليه وسلم

“সাহাবী সাহাল বিন সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন মানূষদের কে নামাযে ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখতে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আবু হাজিম বলেন সাহাল এই হাদিছ টি রসূল(স) এর থেকে বর্ণনা করতেন। (বুখারী ১ম খন্ড,১০২ পৃ)

উক্ত হাদিছে ডান হাত কে বাম যিরার উপর রাখতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু হাত কোথায় রাখবে, নাভির উপরে না নাভীর নিচে, সে সম্পর্কে। উক্ত হাদিসে কিছু বলা হয়নি। এখন আমাদের বুঝা দরকার যে আরবী তে “যিরা” শব্দের অর্থ কি? কনুই থেকে মধ্যমা আঙুল পর্যন্ত অংশ কে আরবি তে যিরা বলা হয়।(মিছবাহুল লুগাত,মুজামুল ওয়াসিত,আল মুনযিদ)।
সে হিসাবে উক্ত হাদিসটি কোনভাবেই হানাফি মাযহাবের বিরোধী নয়, কারণ আমরা নাভীর নিচে ডান হাত কে বাম হাতের কব্জির উপর রাখি এবং কবজি নিংসন্দেহে “যিরা” এর অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং কোন ভাবেই উক্ত হাদিস আমাদের বিরোধী নয় এবং আমরা উক্ত হাদীস মতি আমল করে থাকি। তবে যেহেতু উক্ত হাদিসে স্পষ্ট করে হাত কোথায় রাখা উচিত তা বলা হয়নি, সে জন্য আমাদের কে এ ব্যপারে সুস্পষ্ট হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরাম এর আমল দেখতে হবে।
উল্লেখ্য যে কিছু লোক উক্ত হাদিস দ্বারা নামাজে বুকের উপর হাত রাখাকে সুন্নাত প্রমাণ করতে চায়, অথচ উক্ত হাদিসে বুকের উপর হাত রাখা বিষয়ক কোন শব্দ নেই। সুতরাং উক্ত হাদিস দ্বারা বুকের উপর হাত রাখা কোনভাবেই প্রমাণিত হয়না।

২ নং দলীলঃ

عن واأل بن حجر في حديث طويل : ثم وضع يده اليمني علي ظهر كفه اليسري والرسغ والساعد

“ওয়াইল ইবনে হাজর থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে শেষে তিনি বলেন, অতঃপর রসুল (স) ডান হাত কে বাম হাতের কবজি এবং বাহুর উপর রেখেছেন। ইমাম আবু দাউদ হাদিসটি উল্লেখ করে নিরবতা পালন করেছেন”।
(আবু দাউদ ১ম খন্ড ১০৫পৃ, ছহীহ ইবনে খুযাইমা হাদিস নং ৪৮০
৮৮নং অধ্যায় ১ম খন্ড ২৪৩পৃ, মাআরেদে জামান হাদিস নং ৪৪৭ অধ্যয় নং ৬৩ ১ম খন্ড ১২৪পৃ)

৩নং দলীলঃ

عن واأل بن حجر في حديث طويل : ثم وضع يده اليمني علي يده اليسري في الصلاة قريبا من الرسغ

অনুবাদঃ ওয়াইল ইবনে হাজর থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে শেষে তিনি বলেন অতঃপর রসুল (স) নামাযে ডান হাত কে বাম হাতের কবজির কাছে রেখেছেন।(তালখিসুল হাবির ১ম খন্ড ২২৪ পৃ হাদিস নং ৩৩২, এলাউস সুনান ২য় খন্ড ১৯০পৃ)

৪ নং দলীলঃ

عن قبيصة بن هلب عن ابيه قال كان رسول الله صلي الله عليه وسلم يومنا فياخذ شماله بيمينه رواه الترمزي وقال حسن والعمل علي هذا عند أهل العلم من اصحاب النبي صلي الله عليه وسلم والتابعين ومن بعدهم يرون ان يضع الرجل يمينه علي شماله في الصلاة وراي بعضهم ان يضعهما فوق السرة وراي بـعضهم ان يضعهما تحت السرة وكل ذلك واسع عندهم

অনুবাদঃ কুসাইবা ইবনে হালাব (র) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে রসুল (স) আমাদের নামাযের ইমামতি করতেন এবং ডান হাত দ্বারা বাম হাত কে আকড়ে ধরতেন।
ইমাম তিরমিযি বলেন যে এই হাদিসটি হাসান এর পর্যায়ে। সাহাবায়ে কেরাম ইহার উপর আমল করতেন এবং ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখা কে সুন্নাত মনে করতেন। তবে কেহ নাভীর উপর রাখা কে সুন্নাত মনে করেন এবং কেহ নাভীর নিচে রাখা কে সুন্নাত মনে করেন। তবে উভয় পদ্বতির উপর আমল করা যায়েয হবে। (তিরমিযি শরীফ ১ম খন্ড ৩৪পৃ)


৫নং দলীলঃ

حدثنا يزيد بن هارون قال أنا الحجاج بن حسان قال سمعت أبامجلز أو سألته قلت كيف يضع؟ قال يضع باطن كف يمينه علي ظاهر كف شماله ويجعلهما اسفل عن السرة

হাজ্জাজ ইবনে হাসসান বর্ণনা করেন যে আমি আবু মুজলিজ কে জিজ্ঞেস করলাম যে রসুল (স) নাযাজে হাত কোথায় রাখতেন?
তিনি উত্তর দিলেন যে রসুল (স) নাভীর নিচে ডান হাতের কবজি কে বাম হাতের কব্জির উপর রাখতেন। আল্লামা ইবনে আবি শায়বা হাদিস টি কে ছহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।( মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১ম খন্ড ৩৯০-৩৯১পৃ, আল যাওহারুন নকী ২য় খন্ড ৩১পৃ)

৬ নং দলীলঃ

قال العلامة ابن التركماني ومذهب ابي مجلز الوضع اسفل السرة حكاه عنه ابو عَمر في التمهيد وجاء ذلك عنه بسند جيد
আল্লামা ইবনে তুরকুমানি বলেন আবু মুযলিজ সাহাবীর আমল ছিল যে তিনি নাভীর নিচে হাত রাখতেন। আবু আমর “তামহিদ” নামক কিতাবে তা বর্ণনা করেন এবং উক্ত হাদিস টি তার থেকে বিশুদ্ব সনদে বর্ণিত হয়েছে।
(বাযলুল মাযহুদ শরহে আবু দাউদ ৪র্থ খন্ড ৪৭৭ পৃ, এলাউস সুনান ২য় খন্ড ১৯২পৃ)

৭নং দলীলঃ

حدثنا وكيع عن ربيع عن ابي معشر عن ابراهيم قال يضع يمينه علي شماله تحت السرة رواه ابن ابي شيبة واسناده حسن
“প্রসিদ্ব তাবেয়ি ইব্রাহিম নাখয়ী থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে রসুল (স) নাভীর নিচে ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখতেন। এ হাদিসের সনদটি হাসান। (আসারুস সুনান ১ম খন্ড ৭১পৃ, আসারে মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শাইবানি ২৫ পৃ)”
৮নং দলীলঃ

عن ابي حجيفة ان عليا (رض) قال السنة وضع الكف علي الكف في الصلاة تحت السرة

“আবূ যূহাইফা (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আলী (র) বলেছেন যে সুন্নাত হল নামাযে নাভীর নিচে এক হাত কে আরেক হাতের উপর রাখা। (মুসনাদে আহমদ ১ম খন্ড ১১০পৃ, বায়হাকি শরীফ ২য় খন্ড ৩১পৃ, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১ম খন্ড ৩৯১ পৃ )
উক্ত হাদিস টি আবু দাউদ শরীফে ও বর্ণিত হয়েছে তবে সেটি “ইবনুল আরাবী” এর পান্ডুলিপিতে আছে, “লুলয়ী” এর পান্ডুলিপিতে নয়। (এলাউস সুনান ২য় খন্ড১৯৩পৃ, তাকরিরে তিরমিযী ২য় খন্ড ২৪পৃ)
উল্লেখ্য যে উসূলে হাদিস অনুযায়ী যখন কোন সাহাবী রসুল (স) এর কোন আমল কে “সুন্নাত” বলে আখ্যায়িত করে তখন হাদিসটি মারফু হাদিস এর হুকুমে হয়ে যায়। সে হিসাবে উক্ত হাদিসটি মারফু হাদিস।


এখানে একটি প্রশ আছে। তা হল ইমাম আবু দাউদ উক্ত হাদিস বর্ণনা শেষে বলেন, আমি ইমাম আহমদ ঈবণে হাম্বল থেকে শুনেছি যে তিনি আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক কূফি কে জয়ীফ বলেছেন।


উক্ত প্রশ্নের জবাবে বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আজলী বলেন আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাক কূফি রাবী হিসাবে কিছুটা দুর্বল হলেও তার তার হাদিস গ্রহণ করা যাবে।
আল্লামা জালালুদ্দিন সূয়ুতি বলেন মুসনাদে আহমদের সমস্ত হাদিস গ্রহণযোগ্য, তাছাড়া সেখানে কিছু হাদিসের মধ্যে সামাণ্যতম দূর্বলতা থাকলেও সে গুলো “হাসান” এর পর্যায়ে। (কানযুল উম্মাল ১ম খন্ড ৯পৃ)

ইবনুল হাজম এবং আল্লামা তাকী উস্মানি বলেন হজরত আলীর উক্ত হাদিসে কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও যেহেতু বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরাম যেমন হজরত আবু মুযলিজ,হযরত আনাস এবং হজরত আবু হুরায়রা সহ আরো অনেকে তাবেয়ির আমলের দ্বারা নাভীর নিচে হাত বাধা সাব্যাস্ত এবং প্রমানিত, সেহেতু উক্ত হাদিস টি গ্রহণযোগ্য এবং বিশুদ্ব।( মহল্লি ১৩পৃ ৪র্থ খন্ড, তাকরিরে তিরমিযি ২য় খন্ড ২৪পৃ, এলাউস সুনান ২য় খন্ড ১৯৩পৃ)


৯ নং দলীলঃ

عن أنس رضي الله عنه قال ثلاث من اخلاق النبوة تعجيل الافطار وتاخير السحور ووضع اليد اليمني علي اليسري في الصلاة تحت السرة
“হজরত আনাস (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে তিনটি জিনিষ নবীদের সুন্নাত। প্রথম হল ইফতারের সময় হলে বিলম্ব না করা, দ্বিতীয় হল ভোর রাত্রে শেষ সময়ে সেহরি খাওয়া এবং নামাযে নাভীর নিচে ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখা” (আল যাওহারুন নকী ২য় খন্ড ৩১ও ৩২ পৃ)
১০ নং দলীলঃ

عن ابي واءل (رض) قال قال ابو هريرة (رض) اخذ الاكف علي الاكف في الصلاة تحت السرة

“আবু ওয়াইল (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে আবু হুরায়রা (র) বলেছেন যে নামাযে নাভীর নচে কব্জির উপর হাত রাখা সুন্নাত। (আবু দাউদ ১ম খন্ড ২৭৫পৃ)
আল্লামা শাওকানী বলেন নামাযে হাত বাধা সম্পর্কে আবু ওয়াইল এর উক্ত হাদিসের চেয়ে আর কোন সহীহ হাদিস নেই। (এলাউস সুনান ২য় খন্ড ১৯৫পৃ)
১১ নং দলীলঃ

عن وائل بن حجر عن ابيه رضي الله عنه قال : رأيت النبي صلى الله عليه وسلم يضع يمينه على شماله في الصلاة تحت السرة

ওয়াইল বিন হাজর (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে আমি রসুল (স) কে দেখেছি যে তিনি নামাযে নাভীর নিচে ডান হাত কে বাম হাতের উপর রেখেছেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ১ম খন্ড ৩৯পৃ)

হাফেযুল হাদিস আল্লামা কাসেম ইবনে কাতলুবুগা উপরোক্ত হাদিস সম্বন্ধে বলেন উক্ত হাদিসটি বুকের উপর হাত রাখার হাদিসের চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।

বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা নিমী তালিকুল হাসান কিতাবে বলেন যে উক্ত হাদিসটি যদিওবা মতন এর দিক দিয়ে কিছুটা দুর্বল, তবুও সেটি বুকের উপর হাত রাখার হাদিসের চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং এর সনদ মযবুত।
আল্লামা আবু তৈয়ব মাদানি তিরমিযি শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন উক্ত হাদিসটি সনদের দিক দিয়ে অধিক শক্তিশালী।
শেখ আবেদ সিন্দি তাওয়ালিয়ুল আনওয়ার কিতাবে বলেন উক্ত হাদিসের রাবীগণ নর্ভরযোগ্য। (ফাতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম ৩য় খন্ড ৩০৮ পৃ, তানযিমুল আস্তাত শরহে মিশকাত ১ম খন্ড ৩০২)

قال محمد : أخبرنا الربيع بن صبيح، عن أبي معشر، عن إبراهيم : أنه كان يضع يده اليمنى على يده اليسرى تحت السرة. قال محمد : وبه نأخذ وهو قول أبي حنيفة رحمه الله. (كتاب الصلاة، باب الصلاة قاعدا والتعمد على شيء أو يصلي إلى ستر

“ইব্রাহিম নাকয়ী থেকে বর্ণিত আছে তিনি নাভীর নিচে ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখতেন। (কিতাবুল আসার হাদিস নং ১২১)

ইমাম ইবনে কুদামা হাম্বলী (রাহ) (৬২০ হি.) বলেন, নামাযে কোথায় হাত বাঁধা হবে এ বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা আছে। (ইমাম) আহমদ (রাহ) থেকে বর্ণিত, দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। এটি (হযরত) আলী রা., আবু হুরায়রা রা., আবু মিজলায রাহ., ইবরাহীম নাখায়ী রাহ., (সুফিয়ান) ছাওরী রাহ., ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) রাহ. থেকে বর্ণিত। (আলমুগনী ২য় খন্ড ১৪৩পৃ)


শায়খ আবুল হুসাইন ইয়াহইয়া ইবনে আবুল খায়ের রাহ. (মৃত্যু ৫৫৮ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু ইসহাক (আলমারওয়াযী) রাহ. বলেছেন, ‘এক হাত অন্য হাতের উপর নাভীর নিচে রাখবে।(আলবায়ান ফী মাযাহিবিল ইমামিশ শাফেয়ী ২/১৭৫)
উল্লেখ্য, ইমাম আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ. শাফেয়ী মাযহাবের একজন প্রসিদ্ধ মনীষী। ইমাম শাফেয়ী রাহ. নাভীর উপর (বুকের নিচে) হাত বাঁধার নিয়ম গ্রহণ করলেও আবু ইসহাক মারওয়াযী নাভীর নিচে হাত বাঁধার নিয়মকেই অগ্রগণ্য মনে করেছেন।
ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬ হি.) বলেন, (ইমাম) আবু হানীফা, (সুফিয়ান) ছাওরী ও ইসহাক (ইবনে রাহুয়াহ) বলেন, ‘দুই হাত নাভীর নিচে রাখবে। আমাদের (শাফেয়ী মাযহাবের) মনীষীদের মধ্যে আবু ইসহাক আলমারওয়াযী রাহ.ও তা গ্রহণ করেছেন। আর ইবনুল মুনযির তা বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রা, (ইবরাহীম) নাখায়ী ও আবু মিজলায রাহ. থেকে।
সুতরাং উপরোক্ত হাদিস সমূহের দ্বারা এ কথা স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে নাভীর নিচে হাত রাখা রসুল (স) থেকে প্রমাণিত এবং সাহাবা এবং তাবেইন দের যুগে এটার উপর ব্যাপকভাবে আমল হয়েছে এবং খায়রুল করুনের বিশিষ্ট ইমামগণ এটাকে প্রাধাণ্য দিয়েছেন।

বুকের উপর হাত রাখার হাদিস সমুহ

عن واءل بـن حجر رضي الله عنه قال صليت مع النبي صلي الله عليه وسلم فوضع يده اليمني علي يده اليسري علي صدره

“ওয়াইল ইবনে হাজর (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রসুল (স) এর সাথে নামায পরেছি। তিনি বুকের উপর ডান হাতের উপর বাম হাত কে রেখেছেন”। (ছহীহ ইবনে খুযাইমা ১ম খণ্ড ২৪৩পৃ)
উক্ত হাদিস সমবন্ধে মুহাদ্দিসিনে কেরাম কালাম করেছেন এবং উক্ত হাদিস্টি কে সনদ হিসাবে খুবই দুর্বল হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। নিচে আমি সে সম্পর্কে আলোচনা করছি।
(বুকের উপর) শব্দটি বাস্তবে হাদিসে নেই।علي صدرهবলেন আল্লামা নিমী
কারণ উক্ত হাদিসটি মোট সাত টি সুত্রে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ বিভিন্নজন হাদিসটিকে বিভিন্ন সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
১ ইমাম আহমদ তার মুসনাদে আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ালিদের সুত্রে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
২ ইমাম নাসায়ী “জায়েদা” এর সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
৩ ইমাম আবু দাউদ বশর ইবনে মুফাদ্দাল এর সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
৪ ইবনে মাজা তে আব্দুল্লাহ ইবনে ইদ্রিস এবং বশর ইবনে মুফাদ্দাল এর সুত্রে বর্ণনা এসেছে।
৫ আহমদ আব্দুল ওয়াহিদ,জুহাইর এবং এবং শুবা এর সুত্রে বর্ণনা করেছেন।
৬ “মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালসি” তে সালাম ইবনে সালিম এর সুত্রে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে।
৭ ছহীহ ইবনে হাব্বানে শু’বা এর সুত্রে হাদিস টি বর্ণিত হয়েছে।
উপরের সাতটি সুত্রের কোনটি তে علي صدره বা বুকের উপর হাত রাখা শব্দটি নেই। একমাত্র মোমিল ইবনে ইস্মাইল এর সুত্রে বর্ণনাকৃত হাদিসে “বুকের উপর হাত রাখা” শব্দটি আছে। তাছাড়া উপরোক্ত রাবীগণ মুমিলের চেয়ে অধেক গ্রহণযোগ্য। সুতরাং এতগুলো রাবির বীপরিতে মুমিলের মত একজন দুর্বল রাবির বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবেনা। (ফাতহুল মুলহিম ৩য় খন্ড ৩০৪পৃ, মারেফুস সুনান ২য় খন্ড ৪৩৮পৃ,তানযিমুল আস্তাত ১ম খন্ড ৩০২পৃ, তাকরিরে তিযমিযি ২য় খণ্ড ২২পৃ)
বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুল কাইয়্যুম বলেন একমাত্র মুমিল ইবনে ইস্মাইল ব্যতিত অন্য কেহ বুকের উপর হাত রাখা শব্দটি বর্ণনা করেনি। একমাত্র তিনিই উক্ত শব্দটি বৃদ্বি করেছেন। সুতরাং সমস্ত রাবীর বিপরিতে মোমিলের মত একজন দুর্বল রাবীর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। (এলামুল মুয়াক্কিয়িন ২য় খন্ড ৩১২পৃ,তালিকুল হাসান ১ম খন্ড ৬৫পৃ)
তাছাড়া রাবী যদি বিশ্বস্ত ও হন তারপরেও তিনি যদি অণ্যান্য গ্রহণযোগ্য রাবী অথবা তার চেয়ে শক্তিশালী রাবীর বিরোধিতা করেন তাহলে তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবেনা। এখানে তাই হয়েছে।
মুমিল ইবনে ইস্মাইল কে মুহাদ্দিসিনে কেরাম রাবি হিসাবে খুবই দুর্বল বলেছেন। আল্লাম নিমী বলেন মুমিল ইবনে ইস্মাইল কে বহু মুহাদ্দিস দুর্বল বলেছেন। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা যাহবী “কাশিফ” নামক কিতাবে বলেন মুমিল একজন সত্যবাদি রাবি কিন্তু তার প্রচুর ভূল আছে। তার সম্পর্কে বলা হয়েছে তার কিতাব সমুহ কে মাটির নিচে দাফন করে ফেলা হয়েছিল। ফলে তিনি মুখস্ত হাদিস বর্ণনা করতেন এবং ভূল করতেন।
হাফেযুল হাদিস আল্লামা ইবনুল হাজল আস্কালানি “তাহযিবুত তাহযিব” নামক কিতাবে বলেন ইমাম বুখারি তার সম্পর্কে বলেছেন মুমিল একজন হাদিস আস্বীকারকারী। আল্লামা ইবনুল সাদ বলেন মুমিল গ্রহণযোগ্য, কিন্তু তার প্রচুর ভূল হয়েছে। আল্লামা ইবনুল কানে বলেন মুমিল গ্রহণযোগ্য কিন্তু বেশি ভূল করে। ইমাম দারে কুত্নি তার সম্পর্কে বলেন গ্রহণযোগ্য কিন্তু বেশি ভূল করে। আল্লামা আবু যারআ এবং আবু হাতিম ও অনুরুপ কথা বলেছেন। তাকরিব নামক কিতাবে তার সম্পর্কে বলা হয়েছে সত্যবাদি কিন্তু তার স্বরণশক্তি খুব খারাপ। আল্লামা ইবনুত তুরকামানি “আলজাওহারুন নাকী” নামক কিতাবে বলেন তার সমস্ত কিতাব দাফন করে ফেলা হয়েছিল। ফলে তিনি মুখস্ত হাদিস বর্ণনা করতেন এবং প্রচুর ভূল করতেন। মুহাম্মদ ইবনে নসর আল মারুযি বলেন কোন হাদিস যদি শুধুমাত্র মুমিল থেকে বর্ণিত হয় তাহলে সে হাদিস সম্পর্কে নিরবতা অব্লম্বন জরুরী। কারণ তার স্বরণশক্তি খুব দুর্বল এবং সে প্রচুর ভূল করে।
(ফাতহুল মুলহিম ৩য় খন্ড ৩০৪পৃ, আল উরফুস সুযি ১ম খন্ড২৯০পৃ, মারিফুস সুনান ২য় খন্ড ৪৩৫পৃ, বাযলুল মাযহুদ ২য় খন্ড ২৬পৃ, আসারুস সুনান ৬৫পৃ, তানযিমুল আস্তাত ১ম খন্ড ৩০২পৃ)
মুমিল ইবনে ইস্মাইল এর উক্ত বর্ণনা ভূল হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হল উক্ত রেওয়াআতটি মুমিল সুফিয়ান সাওরি থেকে বর্ণনা করেছেন এবং সুফিয়ান সাওরির মাযহাব ছিল নাভীর নিচে হাত রাখা। সুতরাং উক্ত কথার দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে মুমিল নিজের থেকে “বুকের উপর” শব্দটি বাড়িয়ে দিয়েছেন।(শরহুল মুন্তাকা ২য় খন্ড ২৭৮পৃ, মারেফুস সুনান ৪৩৮পৃ)
শায়খ নাসিরুদ্দিন আল্বানিও উক্ত হাদিসটিকে দুর্বল বলেছেন। (সূত্র http://www.masjidsalauddin.com)
তবে মুসনাদে বাজ্জারে একটি বর্ণনা আছে যেখানে উক্ত হাদিসে عند صدره (বুকের কাছে) শব্দ আছে।
এটার জবাব হল উক্ত হাদিসের ভিত্তি হল মুহাম্মদ ইবনে হাজর এর উপর। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা যাহবি তার সম্পর্কে বলেন, তার বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং উক্ত বর্ণনাটিও গ্রহণযোগ্য নয়। (আযযাওয়াইদ ২য় খন্ড ৩৫পৃ,তাকরিরে তিরমিযি ২য় খন্ড ২২পৃ)

২য় দলীলঃ

عن ابن عباس في قوله تعالي فصل لربك وانحر قال وضع اليمين علي الشمال عند النحرفي الصلاة
رواه البـيهقي في سننه

“ইবনে আব্বাস (র) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি উক্ত আয়াতের তাফসিরে বলেন নামাযে বুকের কাছে ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখবে”। (বায়হাকী শরীফ)
উক্ত হাদিসের সনদ কে মুহাদ্দিসিনে কেরাম অত্যান্ত দুর্বল বলেছেন। কারণ উক্ত হাদিসের সনদে “রুহ ইবনুল মুসাইয়য়াব” নামে একজন দুর্বল রাবি আছেন যিনি হাদিস শাস্ত্রে পরিত্যক্ত। আল্লামা ইবনে হাব্বান বলেন তিনি জাল হাদিস বর্ণনা করেন। সুতরাং তার হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লামা ইবনে আদি বলেন তার হাদিসগুলো সংরক্ষিত নয়। এভাবে তিনি হজরত আলী (র) থেকে এরকম যে সকল হাদিস বর্ণনা করেছেন সবগুলোর একই হুকুম। আল্লামা ইবনে তুরকুমানি বলেন উক্ত হাদিসের সনদে ইযতিরাব আছে। আল্লামা মারদিনি “আল জাওহারুন নকি” নামক কিতাবে প্রমাণ করেছেন যে উক্ত হাদিসের সনদ এবং মতন উভয়টিতে ইযতিরাব আছে। আল্লামা ইবনে কাসির উক্ত তাফসির কে বর্ণনা করে বলেন যে উক্ত তাফসিরটি সঠিক নয়। বরং উক্ত আয়াতের সঠিক তাফসির হল কোরবানির দিন কোরবানির জন্তু জবেহ করা। (তাফসিরে ইবনে কাসির ৪র্থ খন্ড ৫৫৮পৃ, তালিকুল হাসান ১ম খন্ড ৪৯পৃ, এলাউস সুনান ২য় খন্ড ২০০পৃ, তানযিমুল আস্তাত ১ম খন্ড ৩০২পৃ, আল ফাতহুর রাব্বানি ৩য় খন্ড ১৭৪পৃ, আলজাওহারুন নকি ২য় খন্ড ৩০পৃ, তাকরিরে তিরমিযি ২য় খন্ড ২৩পৃ, মারিফুস সুনান ২য় খন্ড ৪৩৮পৃ,ফাতহুল মুলহিম ৩য় খন্ড ৩০৫পৃ)

৩য় দলীলঃ

عن هلب رض كان النبي صلي الله عليه وسلم ينصرف عن يمينه وعن شماله ويضع هذه علي صدره
হুলুব (র) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রসুল (স) বুকের উপর হাত রেখেছিলেন।
আল্লামা নিমি “আসারুস সুনান” নামক কিতাবে শক্তিশালী দলীল দিয়ে এ কথা প্রমান করেছেন যে উক্ত বর্ণনার শব্দে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আসল করা হয়েছে। সুতরাং উক্ত ويضع هذه علي صدره যেটাকে ভূলে يضع هذه علي هذه

বর্ণনা দ্বারা দলীল দেওয়া ঠিক হবেনা।
সুতরাং নামাযে বুকের উপর হাত রাখার যে তিনটি দলীল বর্ণিত হয়েছে তিনটি হাদিসেই সনদের দিক দিয়ে অত্যান্ত দুর্বল যা উপরে বিস্তারির আলোচনা হয়েছে।

সার কথা

সাহাবায়ে কেরাম এবং ইসলামের স্বর্ণ যুগ তথা কুরুনে সালাসার আমল দেখলে আমরা এ ব্যপারে দু ধরণের আমল দেখতে পাই। প্রথমটি হল নাভীর নিচে হাত বাধা এবং দ্বিতীয়টি হল নাভীর উপর বুকের নিচে হাত বাধা। উভয়টি সালাফ থেকে প্রমাণিত এবং উভয়টির উপর আমল করা যাবে যেমন ইমাম তিরমিযি (র)বলেছেন। তবে নাভীর নিচে হাত বাধার দলীল অধিক শক্তিশালী যা উপরে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে বুকের উপর হাত রাখা সালাফ থেকে প্রমাণিত নয় এবং দু একটি বিচ্ছিন্ন বর্ণনায় তা এসেছে যা অত্যান্ত দুর্বল। ইমাম মালেক বুকের উপর হাত রাখাই মাকরুহ বলেছেন। যদি বুকের উপর হাত রাখার সহিহ কোন দলীল থাকত তাহলে তিনি কখনো এটিকে মাকরুহ বলতে পারতেননা।
এখানে আসল কথা হল যেটা খাতেমাতুল মুহাদ্দিসিন আল্লামা আনওয়ার শাহ কাস্মেরি বলেছেন যে আসলে নাভীর নিচে, নাভীর উপরে এবং বুকের কাছে, এ শব্দগুলোর মধে খুব একটা পার্থক্য নেই এবং স্থানগুলোও খুব কাছাকাছি এবং এ শব্দগুলোর অর্থ প্রায় এক।
শায়খ আবেদ সিন্দি এবং শায়খ ইবনুল হুমাম বলেন নাভীর নিচে হাত রাখার হাদিস অধিক শক্তিশালী। যেহেতু বুকের উপর অথবা নাভির নিচে উভয় বর্ণনায় কিছুটা দুর্বলতা পাওয়া যায়, যদি আমরা উভয় বর্ণনাকে বাদ দিয়ে নেকায়া গ্রন্থকার এর কথা মেনে নেই তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়। তিনি বলেছেন ডান হাত কে বাম হাতের উপর রাখা ছহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, কিন্তু বুকের উপর অথবা নাভীর নিচে হাত রাখার ব্যাপারে সুষ্পষ্ট এমন কোন হাদিস নেই যার দ্বারা আমল ওয়াজিব হয়। সুতরাং এখানে আমাদের কে কিয়াসের দিকে ফিরে যেতে হবে।নামাযে দন্ডায়মান অবস্থা হল নম্র ভিক্ষুকের অবস্থার মত। দুনিয়াতে আমরা সম্মানিত ব্যাক্তির সামনে দাড়ানোর সময় হাত নিচের দিকে রাখি, কখনো উপরে উঠাইনা। তদ্রুপ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সামনেও তার সম্মানার্থে আমরা হাত নিচে রাখব । উপরে উঠাবনা।এটাই সম্মানের দাবি। সুতরাং কিয়াস অনুযায়ী নাভীর নিচে হাত রাখাই প্রামাণিত হয়। তবে মহিলারা হাত বুকের উপর রাখবে কারণ সেটার দ্বারা তাদের পর্দা রক্ষা হবে যা তাদের জন্য ফরয। (মিরকাতুল মাফাতিহ ৫০৯পৃ ২য় খন্ড, ফাতহুল মুলহিম ৩য় খন্ড ৩০৬পৃ, মারিফুস সুনান ২য় খন্ড ৪৪৫পৃ, আলুউরফুস সুযি ১ম খন্ড২৯১পৃ, তাকরিরে তিরমিযি ২য় খন্ড ২৪পৃ)

আমাদের দেশে কিছু মানুষ না জেনে না বুঝে এ কথা প্রচার করছে যে নাভীর নিচে হাত বাধার সবগুলো হাদিস দুর্বল। আমি তাদেরকে সবিনয়ে অনুরোধ করব সিহাহ সিত্তাহ সহ অন্যাণ্য ছহীহ হাদিসের কিতাবসমূহ এবং তার বিখ্যাত ব্যাখাগ্রন্থগুসমূহ অধ্যায়ন করার জন্য। তাহলে আমরা সঠিকভাবে সুন্নাহ এর অনুসরণ করতে পারব। তারা আরো বলে থাকেন আমরা নাকি ইমাম আবু হানিফার অন্ধ অনুসরণ করে থাকি এমন কি ছহীহ হাদিস যদি ইমাম আবু হানিফার বিরুদ্বে যায় তারপরেও নাকি আমরা ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ করে থাকি। অথচ এ সব কথা সম্পূর্ণ ভূল এবং আমাদের বিরুদ্বে প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়। যাদের প্রকৃত কোরান সুন্নাহর জ্ঞান নেই একমাত্র তারাই এসব কথা বলতে পারেন। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই আমরা ইমাম আবু হানিফাকে অনুসরণ করিনা, বরং আমরা কোরান ও সুন্নাহ কে অনুসরণ করি। তবে যে সব মাসয়ালা জটিল এবং সবার বোধগম্য নয় এবং ইজতিহাদের প্রয়োজন সে সব মাসয়ালায় ইমাম আবু হানিফা কোরান ও হাদিস থেকে যে সমাধান দিয়েছেন আমরা শুধু সেটার অনুসরণ করি।
আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয় এর ফতওয়া


وخلاصة الموضوع أن أرجح الأقوال هو استحباب قبض اليد اليمنى على رسغ اليد اليسرى، ووضعهما على أسفل الصدر فوق السرة، ويجوز إرسالهما عند السكون ، وذلك هو قول الشافعية ، هذا وليس هناك دليل صحيح على أن
اليدين يسن وضعهما لأعلى الصدر عندالعنق

“বিভিন্ন মতামত থেকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত হল নাভীর উপরে বুকের নিচে ডান হাত কে বাম হাতের উপর কব্জির উপর রাখা। তবে বুকের উপর হাত রাখার উপর কোন ছহীহ দলীল নেই”
ফাতওয়ার শেষাংশে উল্লেখ আছে”


وأنبه إلى أن الأمر واسع كما قال ابن قدامة ،. ولا يجوز التعصب لرأى من الآراء ، والخلاف والتنازع فى هذه الهيئة البسيطة مع عدم الاهتمام بالخشوع الذى هو روح الصلاة والأساس الأول فى قبولها عند اللَّه ، هو ظاهرة مرضية لا صحية . والإسلام قد نهى عن الجدل وبخاصة فى هذه الهيئات البسيطة
“স্বরণ রাখা প্রয়োজন যে এখানে মাসয়ালা প্রসস্ত যে রকম আল্লামা ইবনে কুদামা বলেছেন যে এখানে কোন একটি রায়ের উপর অটল থাকা জায়েয হবেনা। আর নামাজের আসল রুহ এবং কবুল হওয়ার আলামত তথা খুশু এর দিকে দৃষ্টিপাত না করে এ সব নিয়ে ঝগড়া করা (হাত কোথায় রাখব) একটি প্রকাশ্য রোগ। আর ইসলাম বিশেষভাবে এ সমস্ত ব্যাপারে ঝগড়া করা থেকে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দিয়েছে। (সুত্র Click This Link

মিশরের প্রখ্যাত আলেম শাইয়খ আব্দুল আলিম মুতাওয়াল্লি বলেন-

ومن هنا فوضع اليدين في الصلاة على أي صورة سنة من سنن الصلاة لا تبطل بفقدها ، ولا ينبغي أن يكون هذا الخلاف الفقهي بين المذاهب مدعاة للتفرقة والشحناء والبغضاء ، فالأمر فيه واسع ، ولا داعي لتخطئة أي فريق .

“নামাযে যে কোন জায়গায় হাত রাখলে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে, তার দ্বারা নামাজের কোন ক্ষতি হবেনা। মাযহাবগত এই মতবিরোধ যাতে মানুষের মধ্যে দলাদলি,হিংশা এবং বিদ্বেষের কারণ না হয় সে দিকে সবার লক্ষ রাখা উচিত। কারণ এখানে মাসয়ালা প্রসস্ত এবং কোন দল কে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করা উচিত হবেনা”।

فليس هناك من المذاهب الأربعة يذهب إلى وضع اليدين على الصدر. قال الإمام الذهبي رحمه الله: (لا يكاد يوجد الحق فيما اتفق أئمة الإجتهاد الأربعة على خلافه، مع اعترافنا بأن اتفاقهم على مسألة لا يكون إجماع الأمة، ونهاب أن نجزم في مسألة اتفقوا عليها بأن الحق في خلافها) سير أعلام النبلاء 7/17 .
ولا النحر في القيام في الصلاة، وعلى هذا درج الناس إلى وقت غير بعيد. فمن أين جاءنا وضع اليدين على الصدر أو على النحر في الصلاة؟
في ظني أن أول من ظهر بهذا بعض المشتغلين بالحديث الشريف بالهند والمتحاملين على المذاهب الأربعة، أرادوا أن يتميزوا عن أتباع المذاهب الأربعة في صفة الصلاة.. ثم انتقل هذا الأمر إلى بلاد الشام فأخذها مشتغل بالحديث، وظن بعض الناس أن هذا من اجتهاداته وفرائده، فذكر هذا في بعض كتبه وقسا على من يخالفهم.

“চার ইমামের কোন ইমাম বুকের উপর হাত বাধতে বলেননি। প্রখ্যাত আলেম আল্লামা যাহবি বলেন চার ইমামের মতের বাহিরে হক থাকতে পারেনা,চার ইমাম যে বিষয়ের উপর ঐক্যমত্য পোষন করেছেন তার বাহিরে হক থাকার বিশ্বাস করা কে আমরা ভয় করি। (সিয়ারে আলামুন নুবালা ৭ম খন্ড ১৭পৃ)
মানুষ চার ইমামের কথার উপর বহুদিন ধরে আমল করে আসছে, সুতরাং নামাজে বুকের উপর হাত রাখা কোথাথেকে আসল?
আমার ধারণা মতে, ভারতে মাযহাবের বিরোধিতাকারি কিছু লোক এই জিনিষ্টি শুরু করেছে এবং তাদের আসল উদ্দেশ্য হল নামাজের ক্ষেত্রে চার ইমামের বিরোধিতা করা। তারপর ধিরে ধিরে এই জিনিষ্টি সিরিয়ায় চলে গিয়েছে এবং সেখানকারর কিছু লোক এটি গ্রহণ করেছে এবং কিছু লোক মনে করল যে এটা তারা ইজতিহাদ করে বের করেছে। (http://www.masjidsalahuddin.com)

আমাদের দেশে আমরা দেখছি যে কিছু মানুষ নামাজের ব্যাপারে মানুষদের কে বিভ্রান্ত করছেন এবং উদ্দেশ্যগতভাবে হানাফি মাযহাবের আনুসারিত হাদিসগুলোকে দুর্বল বলছেন। যার ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং দলাদলি সৃষ্টি হচ্ছে যা কখনো আমাদের মধ্যে কাম্য ছিলনা। তার মধ্যে একটি বিষয় হল নামাজে নাভীর নিচে হাত রাখা। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবয়ে তাবেয়ি্‌ন, মুহাদ্দিসিনে কেরাম এবং ফোকাহায়ে কেরাম থেকে নিয়ে শত শত বছর ধরে উক্ত আমল টি চলে আসছে যাকে ফেকাহের ভাষায় তাওয়াতুর বলা হয়। এবং এটাই হল উক্ত আমল টি সুন্নাত হওয়ার সবচেয়ে বড় দলীল। এখন কেহ যদি নতুন করে এসে নতুন করে মনগড়া কিছু চালু করতে চায় তাহলে সেটা হাদিসের অপব্যাখা এবং নিজের মনপূজা ছাড়া আর কিছু হবেনা।
আমার জানা মতে শায়খ নাসিরুদ্দিন আল্বানি নামাজে বুকের উপর হাত রাখতে বলেছেন। এখানে উল্লেখ্য যে শায়খ নাসিরুদ্দিন আল্বানি হাম্বলি মাযহাবের অনুসারী ছিলেন (সুত্রঃ ওয়েকেপেডিয়া) তবে তিনি এখানে এসে
স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতা করেছেন এবং বুকের উপর হাত বাধতে বলেছেন।
এখানে যেহেতু তিনি স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতা করেছেন তাই এটি তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার যাকে ফিকাহের ভাষায় তাফাররুদাত বলে। ফোকাহায়ে কেরামের উসূল হল কেহ যদি স্বীয় মাযহাবের বিরোধিতা করে ভিন্ন মত পোষণ করে তাহলে তার কথা অণ্যান্যদের জন্য দলীল হতে পারেনা। তাছাড়া ফোকাহায়ে কেরামদের ৭টি স্থর আছে ৬০০ হিজরির পরে যারা এসেছেন তারা সবাই ৭ম স্থরের। এবং পরের যুগের কোন ফকীহের কথা ততক্ষন গ্রহণযোগ্য হবেনা যতক্ষন সে পূর্ববর্তী ফকীহদের কথার রেফারেন্স না দেয়। (শরহে উকূদে রাসমুল মুফতি)
শায়খ আলুবানি সম্পর্কে সৌদি আরবের প্রাক্তন গ্রান্ড মুফতি আল্লামা বিন বায (র) কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন-

الشيخ محمد ناصر الألباني –ناصر الدين الألباني- من خيرة الناس وهو من العلماء المعروفين بالاستقامة والعقيدة الطيبة والجد في تصحيح الأحاديث, وبيان حالها فهو عمدة في هذا الباب, ولكن ليس بمعصوم, قد يقع منه خطأ في تصحيح بعد الأحاديث أو تضعيفها, ولكن مثل غيره من العلماء, كل عالم هكذا له بعض الأخطاء من الأولين والآخرين, فالواجب على طالب العلم أن ينظر فيما صححه وحسنه وضعفه إذا كان من أهل العلم, من أهل الصناعة يعرف الحديث وينظر في طرقه وينظر في رجاله فإن ظهر له صحة ما قاله الشيخ فالحمد لله, وإلا اعتمد .............. من الأدلة التي سلكها أهل العلم في هذا الباب؛ لأن أهل العلم وضعوا قواعد في تصحيح الأحاديث وتضعيفها
“শায়খ নাসিরুদ্দিন আল্বানি প্রসিদ্ব হাক্বানি আলেম ছিলেন কিন্তু তিনি মাসুম নন, কিছু কিছু হাদিস কে ছহীহ এবং যয়ীফ বলার ক্ষেত্রে তার ভূল হয়েছে, যে রকম অণ্যদের হয়। সাধারণত এ রকম ভূল সবারই হয়ে থাকে। সুতরাং আলেমদের উপর ওয়াজিব শায়খ আলবানি যে সমস্ত হাদিস কে ছহীহ অথবা জয়ীফ বলেছেন সে গুলোর ব্যাপারে গবেষনা করা,যাচাই বাচাই করা, যদি শায়খ আলবানির কথা সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ, অণ্যথায় ওলামায়ে কেরাম দলীলের আলোকে যেটি বলেছেন সেটি গ্রহণ করবে। কারণ মুহাদ্দিসিন কেরাম হাদিস ছহীহ এবং যয়ীফ বুঝার জন্য কায়েদা প্রনয়ন করেছেন।(সূত্র http://www.al-sunan.org)
আল্লামা বিন বায শাইয়খ আলবানি রচিত “ছিফাতুস সালাত” নামক কিতাবের ও কিছু ভূল ধরেছেন এবং সে গুলোর সংশোধন করে দিয়েছেন। বিস্তারিত জানতে উপরের ওয়েবসাইটটি দেখুন।
আল্লামা বিন বাযের উক্ত উত্তর থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে শাইয়খ আলবানির সব কথা দলীল নয়, বরং সে গুলোর ব্যাপারে গবেষনা করা প্রয়োজন। সে হিসাবে বুকের উপর হাত রাখা এটি তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এটি কখনো অন্যদের জন্য দলিল হতে পারেনা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ইসলাম এর প্রথম তিন যুগ এর আমল হল আমাদের দলীল। রসূল (স) বলেন-
خير الناس قرني ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم

পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল মানুষ হল আমার যুগের মানুষ (অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম) এরপর হল তাবেইনগণ এরপর তাবয়ে তাবেয়িনগণ।
উপরোক্ত তিন যুগের জন্য রসূল (স) সার্টিফিকেট প্রদান গিয়েছেন। সুতরাং এর পরে যত বড় আলেম আসুক না কেন, তার কথা কখনো কারও জন্য দলীল হতে পারেনা। যদি কেহ সেটি কে দলীল হিসাবে নিতে চায় তাহলে সে পথভ্রষ্ট হবে।"


উপরের আলোচনার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি যে নাভীর নিচে অথবা নাভীর উপরে (বুকের নিচে) হাত রাখা উভয়টি রসূল (স) এর সহীহ হাদিস এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। যে কোন একটির উপর আমল করা যাবে তবে দলীলের দিক দিয়ে নাভীর নিচে হাত রাখা অধিক শক্তিশালী। এর বাইরে কোন আমল রসূল (স) থেকে প্রমাণিত নাই। তাছাড়া এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, একে অপরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা অজ্ঞতা এবং স্বজনপ্রীতি ছাড়া আর কিছু নয় যা আমরা উপরের আলোচনা দ্বারা বুঝতে পেরেছি।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ি আমল করার এবং যাবতীয় ফিতনা থেকে বেচে থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।


Related Link: 

No comments:

Post a Comment