Pages

Sunday, June 16, 2013

ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া আর না পড়া

ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া আর না পড়া

- তারেক০০০

ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া আর না পড়া – অনেক দিন ধরেই এটি একটি বিতর্কের বিষয়।এই তর্কটি, কোন পদ্ধতি ভাল ও উত্তম শুধুমাত্র এই বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়,বরং ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া যাবে কি যাবে না অর্থাৎ জায়েজ নাকি মানা – এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।এ কারণে সালাতের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।এজন্য বিভিন্ন আলেম উলামাদের এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত লক্ষ্য করা যায় এবং অনেক বই, অনুচ্ছেদ ও পাওয়া যায়।

নামাযের অন্যান্য বিষয়গুলো যেমন রাফয়ে ইয়াদাইন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ২ টি মতামত এর মাঝে কোনটি অধিকতর ভাল তা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা পাওয়া যায়,কিন্তু ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত এর বিষয়টি অনেক গুরুতর,কারণ কারও মতে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত ফরজ,কারও মতে ওয়াজিব,আবার কারও মতে মাকরুহে তাহ্রীমী আর কারও মতে হারাম।

ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত পড়া কি জরূরী? উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তবে কোন নামাযের ক্ষেত্রে, সিরী নামায(ইমাম যখন কেরাত চুপে চুপে পড়েন) এবং জেহরী নামায (ইমাম যখন কেরাত শব্দ করে জোরে জোরে পড়েন), উভয়ের ক্ষেত্রে না যে কোন একটির ক্ষেত্রে।

উত্তর যদি না হয়, তাহলে সে সব হাদীসের ব্যাখ্যা কি যেগুলো দেখতে এ মতামতের বিরোধী মনে হয়?

এই প্রবন্ধটি বা লেখাটি আশা করি আপনার সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে এবং আপনার বুঝে আসবে।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বুঝার তওফীক দান করুন। আমিন।

চার ইমাম এবং উলামা কেরাম গণের মতামতঃ

প্রথমত, ইমাম এবং মুনফারিদ (যে একাকী নামায পড়ে) নামাযে সুরা ফাতিহা পড়বে কি পড়বে না – এ বিষয়ে মুজতাহিদ ইমাম গণের মাঝে কোন মত বিরোধ নেই। সকল ইমাম এবং মুহাদ্দিসগণ একমত যে তাদের কে অবশ্যই সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে এবং এটি বাধ্যতামূলক।তাঁদের এ বিষয়েও ঐক্যমত্য আছে যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদীর অন্য কোন সুরা বা আয়াত পড়তে হবে না যা সাধারণত ইমাম বা মুনফারিদ কে সুরা ফাতিহার পড়ে অবশ্যই পড়তে হয়।

কিন্তু মুক্তাদী যখন ইমামের পিছনে নামায আদায় করবেন, তখন সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কি না তা নিয়ে উলামা দের মাঝে মতবিরোধ আছে।

ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদঃ

তাদের উভয়েরই মত হলঃ জাহরী নামায ( ইমাম যখন কেরাত শব্দ করে জোরে জোরে পড়েন, ফজর, মাগরিব, এশা ) এর ক্ষেত্রে মুক্তাদীর ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পাঠ করার দরকার নেই।কিন্তু সিরী নামায(ইমাম যখন কেরাত চুপে চুপে পড়েন, যোহর, আসর) এর ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে।

ইমাম শাফীঃ

উনার প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, জাহরী নামায এবং সিরী নামায উভয় ক্ষেত্রেই মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে।

এই মতটি যদিও প্রসিদ্ধ, কিন্তু এটি ইমাম শাফীর সর্বশেষ মত ছিল না।
তাঁর কিতাবগুলোর উপর ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই মতটিকে তাঁর পূর্বের মত হিসেবে পাওয়া যায়।

ইবনে কদামাহ তাঁর কিতাব “আল মুগনী” তে এই মতটিকে ইমাম শাফীর পূর্বের মত বলে অভিহিত করেছেন।
(আল মুগনী ৬০১ : ১)

ইমাম শাফীর নিজের লিখা “কিতাবুল উমম” গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি জাহরী নামায এর ক্ষেত্রে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত জরূরী নয়, তবে সিরী নামায এর ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহা পাঠ অবশ্যই জরুরী।
তিনি “কিতাবুল উমম” গ্রন্থে লিখেন, “এব্ং আমরা বলি ইমাম নিঃশব্দে পড়েন এ রকম প্রত্যেক নামাযের ক্ষেত্রে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর অবশ্যই কিরাত পাঠ করতে হবে।”
(আল মুগনী ৬০১ : ১)

“কিতাবুল উমম” ইমাম শাফীর পরবর্তী কিতাবগুলোর মধ্যে একটি যা হাফেজ ইবনে কাসীর তার “আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২৫২ : ১০) এবং আল্লামা সুয়ুতী “হুসনুল মুহাদরাহ” গ্রন্থে দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছেন।এটি প্রমাণ করে যে “কিতাবুল উমম” এর মতামতটি ইমাম শাফী পরে দিয়েছেন।

ইমাম শাফীর মত থেকে অনেক গাইর মুকাল্লীদীন দাবি করেন সুরা ফাতিহা পড়া মুক্তাদীর জন্য ফরয, এমনকি জাহরী নামায এর ক্ষেত্রেও।
দাউদ জাহিরি এবং ইবনে তাইমিয়ার মতে জাহরী নামায এ মুক্তাদীর কেরাত পড়া যাবে না।

ইমাম আবু হানিফাঃ

ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ এবং মুহাম্মদ তাঁরা সবাই তাদের মতামতে এক।তাঁরা বলেছেন, “ইমামের পিছনে মুক্তাদীর পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করা, সেটি সুরা ফাতিহা হোক বা অন্য কোন আয়াত হোক, জায়েজ নেই, সিরী এবং জাহরী উভয় নামাযের ক্ষেত্রে।”

একটি কথা বলা হয়ে থাকে যে, সিরী নামাযের ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহা পড়া ভাল – ইমাম মুহাম্মদের এ রকম একটি মত আছে- এটি সত্য নয়। ইবনে হুমাম এটিকে ইমাম মুহাম্মদের উপর ভ্রান্ত অভিযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং তিনি বলেন, “সত্য হল যে ইমাম মুহাম্মদের মতামত ইমাম আবু হানিফা এবং আবু ইউসুফের মতই ।”
(ফাতহুল মুলহিম ২০ : ২)

উপরের বর্ণনা থেকে কিছু point পাওয়া যায়ঃ

১। জাহরী নামাযের ক্ষেত্রে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া ফরয বা বাধ্যতামূলক - কোন ইমাম এ মত পোষণ করেন নি।
২।কেউ কেউ শুধুমাত্র সিরী নামাযের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক বলেছেন।
৩।হানাফী ইমাম গণের শুধুই একটি মত, তা হচ্ছে মুক্তাদীর জন্য কোন কিরাত নেই।

এই মতটিই পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে সবচেয়ে সঠিক ও সহীহ হিসেবে পাওয়া যায়, যা এ প্রবন্ধে প্রমাণ করা হবে ইনশাল্লাহ।

পবিত্র কোরআনের আলোকেঃ

১।

“আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়, তখন তাতে কান লাগিয়ে রাখ এবং নিশ্চুপ থাক যাতে তোমাদের উপর রহমত হয়। ”
(সুরা আ’রাফ : ২০৪)

হযরত আবু হুরাইরা(রঃ),হযরত ইবনে মাসঊদ(রঃ),হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রঃ),মুজাহিদ(রঃ),ইবনে জুবাইর(রঃ),ইবনে জারীর(রঃ) প্রমখ সাহাবীগণ বলেছেন যে, এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে সালাত এবং জুম’আর খুতবা সম্পর্কে।
(তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ১ : ২৮১)

এই আয়াত দ্বারা যে কেউ সহজে বুঝতে পারবেন যে, মুক্তাদীর ইমামের পিছনে কেরাত না পড়ার জন্য এটি একটি বড় ও পর্যাপ্ত দলিল এবং যখন ইমাম কেরাত পড়তে থাকেন তখন মুক্তাদীর চুপ থাকা ও মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা আবশ্যক।

“তানযীম উল আশতাত” গ্রন্থে উল্লেখ আছে, এই আয়াতটি মুক্তাদীকে ২টি আদেশ দেয়ঃ

১।নীরব থাকা- সিরী এবং জেহরী উভয় নামাযের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে চুপ থাকা
২।মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা- জেহরী নামাযের ক্ষেত্রে।

এ থেকে বুঝা যায় যে,মুক্তাদী জেহরী নামাযের ক্ষেত্রে ইমামের কেরাত মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করার জন্য সম্পূর্ণরূপে চুপ থাকবে এবং সিরী নামাযের ক্ষেত্রেও সে চুপ থাকবে যদিও সে ইমামের কেরাত শুনতে পাই না (১ম আদেশ অনুযায়ী)।

তাছাড়া এই আয়াতটি তে বলা হয়েছে, “আর যখন কোরআন পাঠ করা হয়” (উচ্চস্বরে হোক বা চুপে চুপে হোক, কেউ শুনতে পাক বা না পাক),
এই আয়াতটিতে “শুধুমাত্র যখন তুমি কোরআন শুনতে পাবে” বা “শুধুমাত্র যখন কোরআন উচ্চস্বরে পাঠ করা হয়” – “তখন নিশ্চুপ থাক,অন্যথায় নয়” – এ রকম কোন সীমাবদ্ধতা দেওয়া নেই।

সুতরাং এটি পরিষ্কার যে, এই আয়াতের মানে সিরী নামাযের ক্ষেত্রে অবশ্যই চুপ থাকতে হবে এবং যদি জেহরী নামায হয় তখন মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করাও জরুরী।

এখন, যারা বলে থাকেন যে, এই আয়াতটি সালাতের ক্ষেত্রে নয়, বরং শুধুমাত্র খুতবার সময় চুপ থাকার জন্য নাযিল হয়েছে, তাদের জন্য এটি আরও পরিষ্কার করা জরুরী। এই আয়াতটি শুধুমাত্র নামাযে নিশ্চুপ থাকার জন্যই নাযিল হয়েছে, খুতবার ক্ষেত্রে নয়।তার কারণ হলঃ
হাফেজ ইবনে তাইমিয়া তাঁর “ফতওয়া” কিতাবে লিখেছেনঃ
“পূর্বসূরীদের কাছ থেকে এটি বুঝা যায় যে এই আয়াতটি নামাযের কেরাতের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে এবং কেউ বলেছেন খুতবার ক্ষেত্রে।ইমাম আহমদ লিখেছেন, মুহাদ্দিস ও হাদীস বিশারদ গণ নামাযের কেরাতের ক্ষেত্রে একমত ।”
(ফতওয়া ২৬৯ : ২৩)

ইবনে কদামাহ তাঁর কিতাব “আল মুগনী” তে লিখেছেনঃ
“ইমাম আহমদ আবু দাউদ এর কাছ থেকে বর্ণনা করেন, সবাই একমত যে এই আয়াতটি সালাতের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে।”
(আল মুগনী ৬০১ : ১ )

ইবনে তাইমিয়াও লিখেছেনঃ
“আহমদ এ মত দিয়েছেন যে মুক্তাদীর জন্য কেরাত আবশ্যকীয় নয় যখন ইমাম শ্রবণযোগ্য ভাবে কেরাত পড়েন।”
(ফতওয়া ২৬৯ : ২৩)

ইমাম আহমদ আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ
আহমদ বলেনঃ “আমরা কোন মুসলিম মনীষীর কাছ থেকে কখনো শুনি নি যে যদি ইমাম জোরে কেরাত পড়েন আর মুক্তাদী নীরব থাকে, তাহলে মুক্তাদীর নামায হবে না।” তি্নি আরও বলেন, “এটিই রসুলুল্লাহ (সঃ), সাহাবী, এবং তাবেঈন, হিজাজ এর জনগণ থেকে মালিক, ইরাকের মনীষীদের থেকে তাওরী, সিরিয়ার জনগণ থেকে আওযায়ী এবং মিশর থেকে লাইত, কেউ বলেননি, যে ব্যক্তির ইমাম তিলাওয়াত করল আর সে তা করল না তার নামায শুদ্ধ হবে না ।”
(আল মুগনী ৬০২ : ১ )

ইবনে জারীর ও ইবনে আবী হাতিম তাঁদের তাফসীরে এবং ইমাম বায়হাকী “কিতাবুল কিরাত” এ মুজাহিদ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, “এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে রসূলুল্লাহ (সঃ) এর কিছু সাহা্বী সম্পর্কে যাঁরা ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করতেন।”

যদিও এটি মুরসাল, (যে সনদে একজন তাবী সরাসরি রসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন, মাঝখানে কোন সাহাবীর নাম উল্লেখ না করে), কিন্তু এটি মুজাহিদ থেকে বর্ণিত যিনি “আ’লামুন নাস বিত তাফসীর” নামে পরিচিত যার অর্থ “তাফসীর শাস্ত্রে মানব সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান বা পান্ডিত্যের অধিকারী”, তাই এটি একটি উপযুক্ত প্রমাণ এবং এটি গ্রহণ করা যাবে।

ইবনে জারীর “তাবারী” তে ইয়াসির ইবনে জারীর থেকে হযরত ইবনে মাসঊদ (রঃ) সম্পর্কে আরও একটি হাদীস বর্ণনা করেন যে, ইবনে মাসঊদ (রঃ) নামায পড়তেছিলেন, তখন তিনি কিছু মানুষকে ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করতে শুনলেন। শেষ (নামায) করার পর তিনি বললেন, “সে সময় কি এখনও আসেনি যাতে তোমরা বুঝতে পার? সে সময় কি এখনও আসেনি যাতে তোমরা বুঝতে পার যে - যখন কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক যেভাবে আল্লাহ পাক তোমাদের আদেশ দিয়েছেন?”
(ইলাউস সুনান ৪৩ : ৪; তাবারী ৩৭৮ : ১১)

অতএব,উপরের সমস্ত উক্তি এবং উদ্ধৃতি প্রমাণ করে যে, কোরআনের এই আয়াতটি নাযিল হয়েছে সালাতের ক্ষেত্রে, খুতবার ক্ষেত্রে নয়। এ কথার উপর জোর দেয়ার জন্য বা এর সত্যতা প্রমাণ করার জন্য আরও একটি বিষয় জানা দরকার যে, এটি হচ্ছে মক্কী আয়াত, আর সালাতুল জুম’আ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আরও পরে মদীনাতে। সুতরাং, কোন ভাবেই এই আয়াতটি জুম’আর খুতবার সময় নিশ্চুপ ও নীরবতা পালন করার ক্ষেত্রে নাযিল হয়নি।

২।

“কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর।”
(সুরা মুযযাম্মিলঃ ২০)

এই আয়াতটি নির্দেশ করে, পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করা নামাযে ফরজ।কিন্তু এখানে শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করাকে বলা হয়নি, বরং পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করার কথা বলা হয়েছে।

অনেকে বলে থাকেন, এই আয়াতটিতে সুরা ফাতিহাকে বুঝানো হয়েছে, নামাযে এটি তিলাওয়াত করা সবার জন্য অত্যাবশ্যক কেননা রসূলুল্লাহ (সঃ) হাদীসে বলেছেন,
“সুরা ফাতিহা ছাড়া কোন নাযায গ্রহণ করা হবে না ।”

তাঁরা এই হাদীসের সথে উক্ত আয়াতটির সামঞ্জস্য করেন এভাবে যে, আয়াতে উল্লেখিত 'Maa' শব্দটি অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট (an indefinite term) এবং এই হাদীসটি তার ব্যাখ্যা।এভাবে তাঁরা কোরআনের আয়াতটির অর্থ “নামাযে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত কর (বাধ্যতামূলক বা ফরজ)” বলে থাকেন।

কিন্তু এই ধরণের ব্যাখ্যা শুধুমাত্র তখনই দেয়া হয়ে থাকে যখন (কোন আয়াত বা হাদীস ) বিচার বিশ্লেষণে কারও অজ্ঞতা থাকে (পূর্ণ জ্ঞান না থাকা)।

কারণ, বাস্তবতা হল, এখানে 'Maa' শব্দটি অস্পষ্ট বা অনির্দিষ্ট (an indefinite term) নয়, বরং সাধারণ বা আ’ম। সু্তরাং এক্ষেত্রে আয়াতটি নামাযে পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করার অনুমতি দেয় এবং শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা তিলাওয়াতকে বুঝায় না।এভাবে কোরআনের আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায়, “তাই তিলাওয়াত কর যা তোমার পক্ষে তিলাওয়াত করা সম্ভব” এবং এটিই অধিকতর শুদ্ধ কারণ এই আয়াতটিকে শুধুমাত্র সুরা ফাতিহার মাঝে সীমাবদ্ধ করা আয়াতটির প্রকৃত বা মৌলিক অর্থের পরিপন্থী এবং এটি অশুদ্ধ।

হানাফী ইমাম গণ এভাবেই আয়াত ও হাদীসটির মাঝে সামঞ্জস্য করেন যে, আয়াতটির মাধ্যমে নামাযে পবিত্র কোরআনের যে কোন অংশ তিলাওয়াত করা ফরজ এবং হাদীসটির মাধ্যমে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা ওয়াজিব করা হয়েছে।

আগের আয়াত ও এই আয়াতের ব্যাখ্যা একত্রিত করলে দাঁড়ায়, ইমাম ও মুনফারিদ সুরা ফাতিহা ও পবিত্র কোরআনের অন্য কোন অংশ বা আয়াত তিলাওয়াত করবে, কিন্তু মুক্তাদী কোনটিই করবে না।কারণ পূর্বের আয়াতের মাধ্যমে মুক্তাদীকে কোরআন তিলাওয়াত এর সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে।

ইমামের কেরাত যে মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট - পরে হাদীসের আলোকে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হবে ইনশাল্লাহ।

৩।

“ ……. তোমরা নামাযে তোমাদের স্বর উচ্চ করো না এবং অতিশয় ক্ষীণও করো না, এই দুই এর মধ্যমপন্থা অবলম্বন করো । ”
(সুরা বনী ইসরাঈলঃ ১১০)

ইবনে আব্বাস (রঃ) এই আয়াত নাযিল হওয়ার সময়কার অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন।

এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার সময় রসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কায় গোপনীয়ভাবে ছিলেন।তিনি সাহাবীদেরকে নামায পড়াতেন এবং তাতে উচ্চস্বরে কিরাত পড়তেন।যখন মুশরিকরা তিলাওয়াত শুনতে পেত, তখন তারা কোরআন এর সমালোচনা করত, যিনি এটি নাযিল করেছেন (আল্লাহ পাক) তাঁর সমালোচনা করত, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত এবং যিনি আমাদের কাছে কোরআন নিয়ে আসছেন (রসূলুল্লাহ (সঃ)) তাঁকে গালি দিত। এজন্য আল্লাহ পাক রসূল (সঃ) কে আদেশ দিলেন, “নামাযে এমন উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করবেন না যাতে মুশরিকরা শুনতে পায় এবং এত ক্ষীণ স্বরেও তিলাওয়াত করবেন না যাতে বিশ্বাসীদের শুনতে কষ্ট হয়। ”
(তা’লীক উস সাবীহ ৩৬৬ : ১, মুসলিম)

এ আয়াতে আল্লাহ পাক তাঁর রসূলকে এমন পর্যাপ্ত স্বরে তিলাওয়াত করতে বলেছেন যাতে তাঁর পিছনের সাহাবীরা (নামাযরত) শুনতে পাই। আর এটি তখনই সম্ভব যখন সাহাবীরা চুপ থেকে বা নীরব থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।অতএব, এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে কিরাত পড়া শুধুমাত্র ইমামের দায়িত্ব।তিনি যখন ইমামতি করবেন তখন উচ্চ স্বরে (জেহরী নামায) তিলাওয়াত করবেন এবং মুক্তাদী চুপ থাকবে ও মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং কোন তিলাওয়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখবে না।

এরপর আমরা হাদীসের প্রসংগে আসব।এসব হাদীস গুলো উপরোক্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে যে বিষয় বা আদেশ গুলো এসেছে, তা আরও পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট করবে ইনশাল্লাহ।

হাদীসের আলোকেঃ

১।

আবু সাঈদ আল খুদরী বর্ণনা করেন, “রসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন।তিনি আমাদেরকে নিয়মকানুন স্পষ্ট করে বলে দিলেন এবং আমাদেরকে নামায পড়া শিক্ষা দিলেন আর নির্দেশ দিলেন, তোমরা যখন নামায পড়বে, তোমাদের কাতারগুলো ঠিক করে নিবে।অতঃপর তোমাদের কেউ তোমাদের ইমামতি করবে।সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তাকবীর বলবে।সে যখন তিলাওয়াত করবে, চুপ করে থাকবে।সে যখন ‘গইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালাদদল্লীন’ বলবে, তোমরা তখন ‘আমীন’ বলবে।আল্লাহ তোমাদের ডাকে সাড়া দিবেন। ”
(সহীহ মুসলিম শরীফ ১৭৪ : ১)

২।

আবু হুরাইরা (রঃ) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “ইমাম বানানো হয় তাঁর অনুসরণ করার জন্য।অতএব, সে যখন তাকবীর বলবে, তোমরাও তাকবীর বলবে।যখন সে তিলাওয়াত করবে, চুপ থাকবে এবং যখন সে ‘সামিআল্লাহু লিমান হামিদা’ বলবে, তখন তোমরা বলবে ‘রব্বানা লাকাল হামদ্’। ”
(আবু দাঊদ ৯৬ : ১ ; নাসাঈ শরীফ ৪৬)

এ দুটি হাদীস উপরে উল্লেখিত পবিত্র কোরআনের ১ম আয়াতটির ভাল ও উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেয় এবং ইমাম ও মুক্তাদীর পালনীয় বিষয়গুলো চিহ্নিত করে(পার্থক্য করে)।উপরোক্ত হাদীসগুলোতে যেখানে মুক্তাদীকে ইমামের তাকবীর, রুকু ইত্যাদি অনুসরন করার আদেশ দেয়; সেখানে ইমামের সাথে সাথে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করার কোন আদেশ দেয় না, বরং মুক্তাদীকে চুপ বা নীরব থাকার আদেশ দেয়।এটি প্রমাণ করে যে, যদি মুক্তাদীর জন্য তিলাওয়াত জরুরী হত, তাহলে রসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো বিপরীত আদেশ (চুপ বা নীরব থাকার আদেশ) দিতেন না।সুতরাং কেরাত পড়া ইমামের জন্য ফরজ আর মুক্তাদীর জন্য ফরয চুপ বা নীরব থাকা এবং তিলাওয়াত শুনা।

হাদীস থেকে এটি বুঝা যায় যে, ইমাম যখন ‘ওয়ালাদদল্লীন’ বলবে, মুক্তাদী শুধুমাত্র তখনই কিছু বলবে (উচ্চারণ করবে), সে তখন ‘আমীন’ বলবে। আর তার ‘আমীন’ বলার কারণ হল আল্লাহর কাছে সুরা ফাতিহায় ইমামের করা প্রার্থনাকে আরও মজবুত ও শক্তিশালী করা।
এই সৃষ্টি জগতের পালনকর্তার প্রশংসা করার পর সুরা ফাতিহায় বান্দা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, “আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।সে সমস্ত লোকের পথ যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ(অনুগ্রহ করেছ)।তাদের পথ নয় যাদের প্রতি তোমার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। ”

(সুরা ফাতিহাঃ ৫-৭)

যদি ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সুরা ফাতিহা পড়া আবশ্যকীয় হত, তাহলে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত শেষ করার পর উভয়কে আমীন বলার আদেশ দেয়া হত।কিন্তু রসূলুল্লাহ (সঃ) ইমামের সুরা ফাতিহা শেষ করার পর (সে যখন ‘গইরিল মাগদুবি আ’লাইহিম ওয়ালাদদল্লীন’ বলবে, তোমরা তখন ‘আমীন’ বলবে) মুক্তাদীকে আমীন বলতে বলেছেন।
আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, উপরোক্ত হাদীস থেকে পাই, “ইমাম বানানো হয় তাঁর অনুসরণ করার জন্য”।পরবর্তীতে স্পষ্টত মুক্তাদীকে চুপ থাকার আদেশ দিয়ে রসূলুল্লাদ (সঃ) এটির কারণ বা বাস্তবতা ব্যাখ্যা দিয়েছেন।এর কারণ হল মুক্তাদীর জন্য জরুরী হল তার ইমামের কেরাত শুনা।যদি সেও কেরাত পড়া শুরু করে, তবে তার নিজের কেরাত এর জন্য ইমামের তিলাওয়াতে কান দেয়া বা মনোযোগ দেয়া তার জন্য অসম্ভব
হয়ে পড়বে।

পরবর্তী হাদীস গুলোর মাধ্যমে মুক্তাদীর কেরাত না পড়ার বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে ইনশাল্লাহ।

৩।

জাবীর (রঃ) বর্ণনা করেন, “যার কোন ইমাম আছে, তার জন্য তার ইমামের কেরাতই যথেষ্ট।”
(আল জাওহারুন নিকাহ ১৫৯ : ২, ই’লা’উস সুনান ৬১ : ৪, ইবনে আবি শাইবাহ ৩৭৭ : ১)

ইমাম মুহাম্মদের কাছ থেকেও শব্দের কিছু ভিন্নতার মাধ্যমে এই হাদীসটির বর্ণনা পাওয়া যায়।

৪।

রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “কেউ ইমামের পিছনে নামায পড়লে ইমামের কেরাতই তার কেরাত (অর্থাৎ তার জন্য এটিই যথেষ্ট)।”
(উমদাতুল ক্বারী ১২ : ৩, মুয়াত্তা মুহাম্মদ ৯৬, ই’লা’উস সুনান ৬১ : ৪)

নিচের হাদীসটি এটিকে আরও বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করে।

৫।

আবদুল্লাহ ইবনে শাদ্দাদ বর্ণনা করেন, “রসূলুল্লাহ (সঃ) আসর নামায পড়ালেন।একজন তাঁর (সঃ) পিছনে কেরাত পড়া আরম্ভ করল, এজন্য তার পাশে থাকা আরেকজন তাকে কনুই দিয়ে আঘাত করল (মৃদু ঠেলা দিল)।যখন সে নামায শেষ করল, তখন জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেন আমাকে কনুই দিয়ে আঘাত করলে?’ দ্বিতীয় ব্যক্তিটি উত্তর দিল, ‘রসূলুল্লাহ (সঃ) তোমার সামনে, অতএব আমি তোমাকে ইমামের পিছনে কেরাত পড়তে দিতে পারি না(বা অনুমোদন করি না)’।রসূলুল্লাহ (সঃ) এটি শুনলেন এবং বললেন, ‘যার কোন ইমাম আছে, ইমামের কেরাত তার জন্য তার যথেষ্ট ’। ”
(মুয়াত্তা মুহাম্মদ ৯৮; ই’লা’উস সুনান ৭০ : ৪)

৬।

“এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ (সঃ), প্রত্যেক নামাযে কি কোন কেরাত আছে?’ রসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’।লোকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল, ‘(এটার অর্থ হল) এটি জরুরী।’ রসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, ইমামের কেরাত যথেষ্ট(মুক্তাদীর জন্য)।’ ”
(মজমা উজ জাওয়াইদ ১১০ : ২ )

উপরের সমস্ত হাদীসে বলা হয়েছে যে, ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট।এখান থেকে সম্পূর্ণভাবে ও স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, মুক্তাদী তিলাওয়াত করবে না।কারণ ইমামের কেরাত তার জন্য যথেষ্ট, তাই তো হওয়া উচিত।ইমামের পিছনে মুক্তাদীও যদি তিলাওয়াত করা শুরু করে, তাহলে কোরআনের আয়াতে যে নীরব বা চুপ থাকা এবং শোনার কথা বলা হয়েছে, তা কিভাবে পালন করবে?

ইবনে তাইমিয়াহ তাঁর কিতাব ‘ফতওয়া’ তে লিখেছেন, “ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট।সাহাবা এবং তাবেঈনদের এ বিষয়ে ঐক্যমত্য তা-ই প্রমাণ করে।যে হাদীস গুলো এটি প্রমান করে, তা মুসনাদ এবং মুরসাল।তাবেঈনদের ফতওয়া ও ছিল যে, ইমামের কেরাত যথেষ্ট এবং সবচেয়ে বড় কথা হল এটিই হল সম্পূর্ণ কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী (কোরআন ও সুন্নাহের আলোকে সম্পূর্ণ সহীহ)”।

নিচের হাদীসগুলো প্রমাণ করবে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) ইমামের পিছনে কেরাত পড়াকে অনুমোদন করেন নি বা এতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন।

৭।

আবু হুরাইরা (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “একদা রসূলুল্লাহ (সঃ) উচ্চস্বরে কেরাত পাঠের মাধ্যমে নামায আদায়ের পর পিছনে ঘুরলেন (আমাদের দিকে)।তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘তোমাদের কেউ এখন আমার সাথে (নামাযের মধ্যে) কেরাত পাঠ করেছ কি?’জবাবে এক ব্যক্তি বললেন, ‘হ্যাঁ, আল্লাহর নবী (সঃ)।’তখন নবী করীম (সঃ) বলেন, ‘আমি অবাক হচ্ছিলাম(মনে মনে খুঁজছিলাম), আমার কি হল যে কোরআন পাঠের সময় আমার কষ্ট হচ্ছিল।’ ”
রসূলুল্লাহ (সঃ) হতে এরূপ শোনার পর লোকেরা উচ্চস্বরে কেরাত পঠিত নামাযে তাঁর পিছনে কেরাত পড়া হতে বিরত থাকেন।
(তিরমিযী ৭১ : ১; মালিক ৫১; নাসাঈ ১৪৬ : ১; আবু দাঊদ ১৪৬ : ১; ইবনে মাজাহ ৬১, বায়হাকী ১৫৭ : ২)

ইমরান ইবনে হুসাইন এর বর্ননায়ও এই অসন্তুষ্টির কথা পাওয়া যায়।

৮।

ইমরান ইবনে হুসাইন (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে যোহরের নামায পড়াচ্ছিলেন তখন একজন তাঁর পিছনে ‘সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ’লা’ তিলাওয়াত করছিল।নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে আমার পিছনে সূরা ‘সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ’লা’ পাঠ করেছ? এক ব্যক্তি বলল, আমি।তিনি বললেন, আমি অনুমান করেছি তোমাদের মধ্যে কেউ আমার কাছ থেকে (কুরআন) পাঠ ছিনিয়ে নিচ্ছ (আমার সাথে কুরআন পাঠে প্রতিযোগিতা করছ) ।”
(সহীহ মুসলিম শরীফ ১৭২ : ই’লা’উস সুনান ৫৬ : ৪)

৯।

অন্য একটি হাদীস থেকে জানা যায় এটি তাঁকে (সঃ) দ্বন্দে বা বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বর্ণনা করেন যে, সাহাবীগণ রসূলুল্লাহ (সঃ) এর পিছনে তিলাওয়াত করতেন, তখন রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, তোমরা আমাকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে দ্বন্দে বা বিভ্রান্তিতে ফেলে দাও।
(মজমা উয যাওয়াইদ ১ ১০ : ২; আল জাওহারুন নাকীহ ১৬২ : ১ )

এসব হাদীসগুলো শক্ত দলিল হিসেবে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর পিছনে লোকের কেরাত পড়াতে অসন্তুষ্ট ছিলেন।এটিও পরিষ্কার যে সাহাবারা খুব জোরে তিলাওয়াত করতেন না অন্যথায় এটিকে অসম্মান হিসেবে ধরে নেয়া হত, আর এটি অসম্ভব যে সাহাবাদের চরিত্রে বা মর্যাদায় এরূপ অসম্মান আরোপ করা।

তাছাড়া সাহাবারা যদিও ক্ষীণ কন্ঠে তিলাওয়াত করতেন, তবুও রসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের মানা করতেন কারণ এতে তাঁর কোরআন পাঠে অসুবিধা সৃষ্টি হত।

ইমামের পিছনে মুক্তাদী যদি শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করে এবং অন্য কোন আয়াত তিলাওয়াত না করে তখনও এ রকম অসুবিধা সৃষ্টি হয় আবার যদি অন্য কোন আয়াত তিলাওয়াতও করে তখনও এ রকম অসুবিধা সৃষ্টি হয়।উভয় ক্ষেত্রেই ইমামের বিভ্রান্তিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।তাই আল্লাহর রসূলের এই আদেশটি জেহরী নামাযের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য তেমনি সিরী নামাযের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ এই আদেশটি উভয় নামাযের জন্যই সাধারণ একটি আদেশ।

এরপর আমরা এই প্রসংগে সাহাবীদের আমল এবং তাদের বিভিন্ন বাণী ও হুশিয়ার সম্পর্কে আলোচনা করব।এর ফলে পূর্বে উল্লেখিত কোরআনের আয়াত এবং উপরোক্ত হাদীসগুলোর মাধ্যমে যে বিষয় বা আদেশ গুলো এসেছে, তা আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট হবে ইনশাল্লাহ।

সাহাবাগণের বাণীঃ

আল্লামা আইনী তাঁর বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “উমদাতুল ক্বারী” তে লিখেছেন, ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কেরাত না পড়ার ব্যাপারে প্রায় ৮০ জন সাহাবীর মত পাওয়া যায় (অর্থাৎ তাঁরা কেরাত না পড়তে বলেছেন) ।তাঁদের অনেকে আবার এই মতটিতে অনেক জোর দিয়েছেন এবং কেরাত পড়াকে বৈধ বলেননি।

এখানে তার কিছু মতামত ও বাণী তুলে ধরা হল যাতে এ বিষয়টির গুরূত্ব বুঝা যায় এবং এই বিষয়ে সাহাবাদের অবস্থান বুঝা যায়ঃ

১।

আতা ইবনে ইয়াসার (রঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি একবার যায়েদ ইবনে সাবিত (রঃ) কে নামাযে ইমামের পিছনে কেরাত পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন।জবাবে যায়েদ ইবনে সাবিত (রঃ) বলেছিলেন, নামাযে ইমামের পিছনে কেরাত প্রয়োজন নেই।
(সহীহ মুসলিম শরীফ ২১৫ : ১)

২।

মালিক নাফি (রঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রঃ) কে প্রশ্ন করা হত, ইমামের পিছনে কেউ কুরআন পঠ করিবে কি? তিনি বলিতেন, তোমাদের কেউ যখন ইমামের পিছনে নামায পড়ে তখন ইমামের কেরাতই তাহার জন্য যথেষ্ট। আর একা নামায পড়িলে অবশ্য কুরআন পাঠ করিবে (নিজে নিজে) ।বর্ণনাকারী বলেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রঃ) নিজেও ইমামের পিছনে কুরআন পাঠ করিতেন না।
(মালিক মুয়াত্যা ৫১ ; ই’লা’উস সুনান ৭৬ : ৪)

৩।

উবায়দুল্লাহ ইবনে মুকসিম বর্ণনা করেন যে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমর, যায়েদ ইবনে সাবিত এবং জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন (এই বিষয়ে) ।তাঁরা বলেন যে, ইমামের পিছনে কোন সালাতেই কেউ তিলাওয়াত করবে না।
(আতারুস সুনান ১১৬ : ১ ; ই’লা’উস সুনান ৮১ : ৪ )

পরবর্তী বর্ণনায় অসন্তুষ্টির পরিমাণ দেখুনঃ

৪।

আলকামাহ বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রঃ) বলেন, ইমামের পিছনে কেরাত পড়া লোকের মুখ মাটি (ইট বা পাথরের টুকরা) দিয়ে পূর্ণ করা হবে।
(আতারুস সুনান ১১৬ : ১ ; ই’লা’উস সুনান ৮১ : ৪ ; সুদাদ ৮৭ : ৪)

৫।

আবু জামরাহ বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, ইমাম যখন আমার সামনে থাকবে তখন কি আমি তিলাওয়াত করব? তিনি উত্তর দিলেন, না।
(আতারুস সুনান ১১৬ : ১ ; ই’লা’উস সুনান ৮১ : ৪ ৯)

৬।

ইবনে আব্বাস (রঃ) জানিয়েছেন যে (মত প্রকাশ করেছেন) ইমামের কেরাত তোমাদের জন্য যথেষ্ট, সেখানে ইমাম নীরবে পড়ুক অথবা জোরে পড়ুক।
(দারুন কুতনী ৩৩১ : ১ ; ই’লা’উস সুনান ৮২ : ৪ )

৭।

মুসা ইবনে আকাবাহ জানিয়েছেন যে রসূলুল্লাহ (সঃ), হযরত আবু বকর, হযরত উমর এবং হযরত উসমান (রঃ) ইমামের পিছনে কেরাত পড়তে নিষেধ করতেন।
(উমদাতুল ক্বারী ৬৭ : ৩ ; ই’লা’উস সুনান ৮৪ : ৪)

৮।

মুসা ইবনে সা’দ ইবনে জায়েদ তাবিত তাঁর দাদা জান থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি (তাঁর দাদা জান)বলেন, যে ইমামের পিছনে কেরাত পড়ে তার জন্য কোন নামায নেই(তার নামায হল না)।
(মুয়াত্যা মুহাম্মদ ১০০ ; ই’লা’উস সুনান ৮৭ : ৪)

৯।

ইব্রাহীম নাখাঈ বলেন, “(ধর্মে) প্রথম সৃষ্টি নতুন বিষয় হল ইমামের পিছনে কেরাত পড়া। সাহাবারা ইমামের পিছনে কেরাত পড়তেন না। ”
(আল জাওহারুন নাকিহ ১৬৯ : ৪)

এই মতটি আরও গুরুত্ব পাবে নিচের বর্ণনায়ঃ

১০।

ইব্রাহীম নাখাঈ বলেন, ইমামের পিছনে কেরাত পড়া প্রথম ব্যক্তি একজন দোষী বা অভিযুক্ত (বেদাত সৃষ্টিকারী) ।
(মুয়াত্যা মুহাম্মদ ১০০ ; ই’লা’উস সুনান ৮৯ : ৪)

মুহাম্মদ ইবনে সিরীন আমাদের বলেনঃ

১১।

“সুন্নাহের আলোকে ইমামের পিছনে কেরাত পড়াকে আমি অনুমোদন করি না ।”
(ইবরি আবি শাইবাহ ৩৭৭ : ১; ই’লা’উস সুনান ৯০ : ৪)

১২।

আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ ইবনে ইসলাম তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ (সঃ) এর ১০ জন সাহাবী ইমামের পিছনে কেরাত পড়াকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন।তারা হলেনঃ আবু বকর সিদ্দীক(রঃ), উমর ফারুক(রঃ), উসমান বিন আফফান(রঃ), আলী ইবনে আবি তালিব(রঃ), আবদুর রহমান ইবনে আউফ(রঃ), সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস(রঃ), আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রঃ), যাইদ ইবনে তাবিত(রঃ), আবদুল্লাহ ইবনে উমর(রঃ) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রঃ)।
(ক্বলায়দুল আযহার ৪২ : ২)

১৩।

হযরত আলী (রঃ) বর্ণনা করেন, “যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করল, তার নামায শুদ্ধ হল না। ”

অন্য একটি হাদীসে তিনি বলেন, “সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। ”
(আল জাওহারুন নাকিহ ২১৮ : ২, ইবনে আবি শাইবাহ ৩৭৬ : ১)

১৪।

সা’দ (রঃ) বলেন, “I would like a burning ember (জ্বলন্ত কয়লা) to be in the mouth of the one who recites behind the Imaam.”
(আবদুর রাজ্জাক ১৩৮ : ২ ; ইবনে আবি শাইবাহ ৩৭৬ : ২)
উমর ইবনুল খাত্তাব (রঃ) কি বলেন, শুনুন।

১৫।

তিনি বলেন, “If only there could be a stone (পাথর) in the mouth of the one who recites behind the Imaam. ”
((আবদুর রাজ্জাক ১২৮ : ২)

হুযুরে পাক (সঃ) এর এরকম মহান ও মর্যাদাপূর্ণ সাহাবীগণ যারা স্কলারও ছিলেন, আবু বকর (রঃ), উমর (রঃ), উসমান (রঃ), আলী (রঃ), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রঃ), যাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রঃ), আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রঃ), সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রঃ), আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রঃ) এবং বড় বড় তাবেঈন যেমন মুহাম্মদ ইবনে সিরীন (রহঃ), ইবরাহীম ইবনে নাখাঈ (রহঃ), আওযায়ী (রহঃ) ইত্যাদি – সমস্ত বুযুর্গরা একই মত প্রকাশ করেছেন।
“ইমামের পিছনে মুক্তাদীর জন্য কোন কেরাত নেই।”

তাঁদের মাঝে অনেকেই তাদের মতামতের উপর খুব শক্ত অবস্থানে ছিলেন এবং সবাইকে মেনে চলার উপদেশ দিতেন বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন আর অন্যদের অনেকেই ইমামের পিছনে কেরাত পড়াকে নতুন সৃষ্টি বা প্রচলনও বলেছেন।

তাঁদের অনেকের মতামত এরকমঃ “(ইমামের পিছনে) কেরাত পড়নেওয়ালার মুখ জ্বলন্ত কয়লা বা পাথর দিয়ে পূর্ণ করে দেওয়া হোক।”

অন্যরাও এই বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরে অনেকটা এরকম মতামত দিয়েছেন।

অনেকে এই বিষয়ের উপর এতই গুরুত্ব দিয়েছেন যে তাঁরা এ কথাও বলেছেন, যে ইমামের পিছনে পাঠ করবে তার সালাতই হবে না।

হানাফীদের মতামত এসব মতামত অনুসারেই … “ইমামের পিছনে কিছু পড় না কারণ ইমামের কেরাতই পর্যাপ্ত। ” 

বিবেক বুদ্ধি কী বলেঃ

১।

ইমামকে, অন্য সবার মত, সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু তাঁকে এও আদেশ দেয়া হয়েছে যে যাহরী সালাতে যেন তার তিলাওয়াত মুক্তাদী শুনতে পারে যে আদেশ শুধুমাত্র ইমামকে দেয়া হয়েছে অন্য কাউকে না।এখন মুক্তাদী যদি নিজেই তিলাওয়াতে নিমগ্ন থাকে, তাহলে তারা ইমামের কেরাত শুনায় মনোযোগী হতে পারবে না।তাহলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে, শরীয়াতে ইমামকে এমন জামায়াতকে নেতৃত্ব দিতে বলা হয়েছে যে জামাতের মুক্তাদীরা তার তিলাওয়াতে মনোযোগীই না যেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং শরীয়াত কখনো এ ধরণের আদেশ দিতে পারে না।

২।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সুরা ফাতিহার একটি অংশে প্রার্থনা আছে যা পাঠ করনে ওয়ালা পড়ার সময় করে থাকে।সবাই এই প্রার্থনাটি নিজেই নিজের জন্য করে থাকে শুধুমাত্র মুক্তাদী ব্যতীত যেটা ইমাম করে থাকে সবার পক্ষ থেকে।

এখন আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে আমরা দেখতে পাই, যখন অনেক মানুষ একত্র হয়ে বা কোন গ্রুপ বা কোন সংগঠন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে কোন বিষয়ে আবেদন করতে যাই, তারা কিন্তু প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে আবেদন করে না বরং তাদের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি আবেদন পেশ করে থাকে।সে তাদের পক্ষ থেকে সব ধরণের অনুরোধ ও আবেদন দরখাস্ত পেশ করে কিন্তু এজন্য অন্যদের কেউ তাকে দোষারুপ করে না যদি না সে ভুল করে।এরপরও যদি কেউ তার বিরোধীতা করে এবং বলে যে কেন শুধু একজন আবেদন করেছে,আমিও করব, তখন বাকী সবাই সে বিরোধীতা কারীকে দোষারুপ করে এবং অজ্ঞও বলে।

ঠিক তেমনিভাবে মুক্তাদীদের পক্ষ থেকে ইমাম মহান আল্লাহর দরবারে সবার জন্য মিনতি সহকারে প্রার্থনা করে।আর মুক্তাদী নীরব থেকে সেই প্রার্থনা শুনে।হ্যাঁ, তারপর যখন তার প্রার্থনা শেষ হয়,তারা সবাই ইমামের পিছনে থেকে আমীন বলে সেই প্রার্থনাকে অনুমোদন করে (তাদের পক্ষ থেকে সম্মতি প্রদান করে এবং কবুল করার আবেদন জানায়) যেভাবে কোন দল বা সংগঠনের সদস্যরা আবেদনপত্রে সই করে সম্মতি দেয়।

৩।

কেরাত যা সালাতে পাঠ করতে বাধ্য,সেটাকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ প্রথমত সুরা ফাতিহা পাঠ করা এবং দ্বিতীয়ত সুরা ফাতিহার পর কোরআনের কোন সুরা বা অংশ তিলাওয়াত করা।

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, কোন উলামাই এ কথা বলেননি যে “ মুক্তাদী দ্বিতীয় অংশ তিলাওয়াত করতে বাধ্য ”, বরং তার পরিবর্তে তারা বলেছেন, “ ইমামের কেরাত তাদের জন্য যথেষ্ট এবং পর্যাপ্ত ”। তাহলে কেন কিছু উলামা এ কথা বলেন যে, প্রথম অংশ অর্থাৎ সুরা ফাতিহা পাঠ মুক্তাদীর জন্য আবশ্যক কিন্তু দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ কোরআনের কোন সুরা বা অংশ তিলাওয়াত আবশ্যক না? ইমামের দ্বিতীয় অংশের কেরাত যেমন মুক্তাদীর দ্বিতীয় অংশের জন্য যথেষ্ট ঠিক তেমনি ইমামের প্রথম অংশের কেরাত অর্থাৎ সুরা ফাতিহা পাঠও মুক্তাদীর প্রথম অংশের জন্য যথেষ্ট অর্থাৎ দুটি ক্ষেত্রেই ইমাম আর মুক্তাদীর জন্য একই আদেশ। সুতরাং ইমামের কেরাতই যথেষ্ট।

৪।

যদি কোন ব্যক্তি কোন কারণে দেরি করে আসে এবং ইমামকে রুকু অবস্থায় পায়,তাহলে তার জন্য জামাতে শরীক হওয়ার নিয়ম হলঃ সে প্রথমে তাকবীর বলবে,কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকবে,এক সেকেন্ডের জন্য হলেও, তারপর ইমামের সাথে রুকুতে শরীক হবে।এই রাকাতটা তার জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তাকে এই রাকাতটি পরে আলাদা ভাবে পড়তে হবে না।

প্রত্যেক ইমাম মুহাদ্দিসগণ এ বিষয়ে একমত যে যদি সে তাকবীর বা কিয়াম miss করে (করতে না পারে),তখন এই রাকাতটি তার জন্য অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং তাকে শেষে এই রাকাতটি আবার পড়তে হবে।কিন্তু কোন স্কলার এই রকম মতামত দেন নি যে তার রাকাতটি গ্রহণ করা হবে না কারণ সে সুরা ফাতিহা পড়তে ব্যর্থ হয়েছে।এতেই প্রমাণিত হয় যে সুরা ফাতিহা পড়া মুক্তাদির জন্য ফরয নয় যেখানে তাকবীর বলা এবং কিয়াম করা ফরয। এতে এও প্রমাণিত হয় যে, ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট।

৫।

যদি ইমাম সালাতে কোন ভুল করে,সকল মুক্তাদীকে ইমামের সাথে সিজদাহ সাহু আদায় করতে হবে এবং যখন ইমাম সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে,তখনও মুক্তাদীকে সিজদাহ সাহু আদায় করতে হবে,যদিও এটা কোন সিরী নামাযের মধ্যে হয়ে থাকে যেখানে মুক্তাদী ইমামকে তিলাওয়াত করতে শুনে না (তবুও মুক্তাদীকে সিজদাহ সাহু আদায় করতে হবে)।অতএব ইমামের একটি মাত্র ভুল যদি সম্পূর্ণ জামাতের জন্য যথেষ্ট হতে পারে, তাহলে কেন ইমামের কেরাত তাদের সবার জন্য যথেষ্ট হবে না?

আপাত দৃষ্টিতে এই মতামতের বিরোধী হাদীসগুলোর সঠিক বিশ্লেষণঃ

কিছু সহীহ এবং দুর্বল হাদীস আছে যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে দেখলে উপরে উল্লেখিত আয়াত এবং হাদীসগুলোর পরিপন্থী বলে মনে হয়।এ কারণে কিছু স্কলার ইমামের পিছনে কেরাত পড়াকে বাধ্যতামূলক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।

এসব হাদীসে অনেক তথ্য ও প্রমাণ আছে যা এ বিষয়ের সমস্ত সন্দেহ,ভুল বোঝাবুঝি ও ভুল ব্যাখ্যা দূর করবে এবং তাদের আসল অর্থ ও তাৎপর্য বের করে আনবে যা পূর্বে উল্লেখিত হাদীসগুলোর সাথে একমত পোষণ করে।

এই অংশে শুধুমাত্র কিছু গুরূত্বপূর্ণ ও ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ ও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে,কারণ সব গুলোর বিচার বিশ্লেষণ লিখতে গেলে হয়ত পুরো একটি বই লিখতে হবে।যাই হোক, সবার শেষে কিছু উপকারী ও অধিকতর তথ্যপূর্ণ কিতাব ও বইয়ের নাম উল্লেখ করা হবে তাদের জন্য যারা এ বিষয়ে আরও অধিকতর জ্ঞান অর্জন করতে চান এবং এ বিষয়ের আরও গভীরে ঢুকতে চান।

০১।

উবাদাহ বিন সামিত (রঃ) বর্ণনা করেন,রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “ যে ব্যক্তি সুরা ফাতিহা পড়ল না,তার নামায হল না। ” অন্য একটি রেওয়ায়েতে তিনি বলেন, “ যে ব্যক্তি সুরা ফাতিহা এবং অন্য কিছু আয়াত পড়ল না,তার নামায হল না। ”

এটি একটি সহীহ হাদীস যেটির মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে মুক্তাদির জন্য সুরা ফাতিহা পড়া ফরয।যাই হোক, যদি এই হাদীসটির সঠিকভাবে বিশ্লেষন ও ব্যাখ্যা করা হয়,তাহলে উপরে উল্লেখিত আয়াত এবং হাদীসের সাথে তা সম্পূর্ণ মিলে যায় এবং সেখানে আর কোন অসংগতি থাকে না।

এটির ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে দেওয়া যায়। যেমনঃ

(i)

এই হাদীস অনুসারে ইমাম এবং মুক্তাদী উভয়ের জন্যই সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত বাধ্যতামূলক কারণ এটি একটি সাধারণ আদেশ(যা সবার জন্য হয়ে থাকে) যার ফলে ইমামের পাশাপাশি এখানে মুক্তাদীকেও বুঝানো হয়েছে। হানাফীরা এই হাদীসটিকে বাদ দেয় নি বা বাতিল করে নি, কিন্তু তারা বলে যে ইমামের কেরাতের পিছনে মুক্তাদী এই আবশ্যকতা থেকে অব্যাহতি পায় কারণ রসূলুল্লাহ (সঃ) এও বলেছেন যে ইমামের কেরাতই মুক্তাদির কেরাত।সুতরাং এটা ধরা হবে যে মুক্তাদী তার উপর অর্পিত দায়িত্ব এ হাদীসটির মাধ্যমে পূরণ করেছে(কারণ ইমামের কেরাত পড়া মানে মুক্তাদীর কেরাত পড়া)।

(ii)

যেহেতু কোরআনের আয়াত এবং সাথে অন্যান্য সহীহ হাদীসগুলোতে মুক্তাদীকে নীরব থাকা ও শুনার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে,সুতরাং মুক্তাদী এ বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে এবং হাদীসটিতে শুধুমাত্র ইমাম ও মুনফারিদ (যে একাকী নামায পড়ে) এর জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়।

(iii)

কিছু সহীহ হাদীস (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) মুক্তাদীর তিলাওয়াত করাকে নিষেধ করেছে।সুতরাং সে এই নির্দিষ্ট হাদীসের আদেশ ও বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পাবে।এই আদেশ ও বাধ্যবাধকতা শুধুমাত্র ইমাম ও মুনফারিদ (যে একাকী নামায পড়ে) এর জন্য।

(iv)

প্রথম রেওয়ায়েতে শুধুমাত্র সুরা ফাতিহার কথা উল্লেখ আছে এবং দ্বিতীয় রেওয়ায়েতে “ফাসাইদান” শব্দটিরও উল্লেখ আছে যার অর্থ “এবং অতিরিক্ত”। এখানে সবচেয়ে আশ্চর্য্যকর ব্যাপার এই যে যেসব স্কলার মুক্তাদীর জন্য সুরা ফাতিহা পাঠ আবশ্যকীয় বলে মতামত দেন তারা কিন্তু এ কথা বলেন না যে সুরা ফাতিহার সাথে সাথে অন্য আয়াতও অবশ্যই পাঠ করতে হবে, অথচ দ্বিতীয় রেওয়ায়েতে সুরা ফাতিহার পাশাপাশি অন্য কোন আয়াত পাঠের আবশ্যকীয়তার কথাও বলা আছে।এভাবে তারা যে কারণ ও ব্যাখ্যার মাধ্যমেই হোক না কেন অন্য কোন আয়াত পাঠ করাকে জরুরী বলেননি, ঠিক তেমনি সে রকম কারণে আমরা সুরা ফাতিহা ও অন্য কোন আয়াত, উভয়টি পাঠ করাকে মুক্তাদীর জন্য জরুরী বলি না।পার্থক্য শুধু এই যে, আমরা সম্পূর্ণ হাদীসটিকে বিবেচনা করেছি এবং উভয় অংশের জন্য (সুরা ফাতিহা এবং সাথে অন্য কোন আয়াত) একই আদেশের কথা বলেছি যে মুক্তাদী ইমামের কেরাতের মাধ্যমে উভয় অংশ পাঠ করা থেকে অব্যাহতি পাবে।অথচ অন্যান্য স্কলাররা শুধুমাত্র সুরা ফাতিহা পাঠ করাকে জরুরী বলেছেন, সাথে অন্য কোন আয়াত তিলাওয়াতকে জরুরী বলেন নি।যদি এই ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে, ইমামের সুরা ফাতিহার পরের অংশ তিলাওয়াত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট, তাহলে আমরা এটাও বলতে পারি যে ইমামের উভয় অংশের তিলাওয়াতই মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট কারণ পূর্বে উল্লেখিত হাদীসে বলা হয়েছে ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট।

(v)

এই হাদীসটি মুক্তাদীকে আদেশ দেয় না,বরং ইমাম এবং মুনফারিদকে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াতের আদেশ দেয়।পরের হাদীসে রসূলুল্লাহ (সঃ) এর একজন সাহাবী ঠিক এই মতটিই প্রদান করেন।ইমাম তিরমিযী হযরত যাবীর (রঃ) এর হাদীস সহীহ সনদে বর্ণনা করেন,যেখানে তিনি বলেন, “ যে ব্যক্তি একটি রাকাত পড়ল যেখানে সে সুরা ফাতিহা পড়ল না,তখন সেটি এমন যেন সে তা (নামায) পড়ল না,যদি না সে ইমামের পিছনে থাকে ।”

(তিরমিযী ৭১ : ১)

এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, হাদীসের আদেশটি মুক্তাদীর জন্য নয়।
উপরোক্ত হাদীস সম্পর্কে ইমাম তিরমিযী ইমাম আহমদ এর মতামতও উল্লেখ করেছেন,

“ ইনি রসূলুল্লাহ (সঃ) এর একজন সাহাবী যিনি রসূলুল্লাহ (সঃ) এর ‘ যে ব্যক্তি সুরা ফাতিহা পড়ল না তার নামায হল না ’ এ কথার ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে এই আদেশ শুধুমাত্র একাকী নামায পড়নে ওয়ালার জন্য।”
(ই’লা’উস সুনান ৭৫ : ৪)

রসূলুল্লাহ (সঃ) এর হাদীসের অর্থ ও ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ (সঃ) একজন ঘনিষ্ঠ সাহাবীর চেয়ে কে বেশি ভাল দিতে পারে?

০২।

উবাদাহ বিন সামিত (রঃ) বর্ণনা করেন, “ আমরা রসূলুল্লাহ (সঃ) এর পিছনে ফজরের সালাত আদায় করছিলাম।তিনি তিলাওয়াত শুরু করলেন কিন্তু তাঁর পাঠ তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে,তাই নামায শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তোমরা সম্ভবত ইমামের পিছনে কেরাত পড়ছিলে?’ জবাবে আমরা বলি, হাঁ, ইয়া রসূলুল্লাহ। রসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, ‘ সুরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য কিছু পাঠ করবে না, কারণ যে এটি পড়বে না তার নামায হবে না। ’ ”

আবু দাঊদ,তিরমিযী এবং নাসাঈ একই রকম বর্ণনা পেশ করেন এবং আবু দাঊদের একটি রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, “ রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, ‘আমি এইরূপ চিন্তা করি যে, আমার সাথে তারা কোরআন পাঠে প্রতিযোগিতা করছে।আমি নামাযের মধ্যে যখন উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করি,সুরা ফাতিহা ছাড়া পবিত্র কোরআনের কোন অংশ তিলাওয়াত করবে না।’ ”
(মিশকাত শরীফ ৮১ : ১, আবু দাঊদ,তিরমিযী,নাসাঈ থেকে)

অর্থাৎ মুক্তাদীকে সুরা ফাতিহা, যা আবশ্যকীয়, ছাড়া অন্য কোন কেরাত পড়তে হবে না।

অনেকগুলো কারণ আছে যেসবের জন্য এই হাদীসটিকে এই অর্থে গ্রহণ করা যাবে না অথবা এটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে হবে।

(i)

এই রেওয়ায়েতে রাবীদের তালিকায় মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক নামে একজন আছে যার সম্পর্কে কেউ কেউ ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বললেও অধিকাংশ ‘আইয়ম্মা তুর রিজাল’ সরাসরি তার সমালোচনা করেছেন।সুলাইমান আত তাইমি এবং হিশাম তাকে ‘কাযযাব’ বলেছেন, ইমাম মালিক তাকে দাজ্জালদের মধ্যে ‘দাজ্জাল’ উপাধি দিয়েছেন।ইবনে যাহীর,ওয়াহাব ইবনে খালীদ,যাবীর ইবনে আবদিল হামিদ এবং দারু কুতনী প্রমুখগণও তার সম্পর্কে অনেক গুরূত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন।অতএব,এ রকম সনদ গ্রহণ করা সম্পূর্ণ অনৈতিক।

(ii)

দ্বিতীয়ত, এই সনদে অনেক বিভ্রান্তি আছে।মাঝে মাঝে মাখুল মুহাম্মদ ইবনে রাবী থেকে হাদীস বর্ণনা করেন,এবং মাঝে মাঝে নাফি ইবনে মুহাম্মদ থেকে,কিছু সংখ্যক মাত্র।নাফি ইবনে মুহাম্মদ সম্পর্কে স্কলাররা,যেমন ইবনে আবদিল বার, তাহাবী, এবং ইবনে কদামাহ বলেছেন যে, তিনি অপরিচিত।যেহেতু এই বিষয়ে বিপুল সংখ্যক হাদীস আছে যা ত্রুটিহীন, সেহেতু উপরোক্ত হাদীসের প্রয়োগ এখানে উচিত নয় কারণ এটি পূর্বের হাদীসগুলোর বিরোধী বা সেগুলোর সাথে অসংগতিপূর্ণ।

(iii)

এই হাদীসটি মা’লুল এবং একে উবাদাহ (রঃ) এর উপর মাওকুফও বলা যায়, মারফূ না।

ইবনে তাইমিয়াহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন,

“ মুহাদ্দিসগণের কাছে বিভিন্ন কারণে এই হাদীসটি মা’লুল। ইমাম আহমদ এবং অন্যান্যরা বলেছেন, হাদীসটি দুর্বল। এই দুর্বলতা নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য জায়গায়(একই বই) উল্লেখ রয়েছে এবং সেখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে (প্রমাণ করা হয়েছে) যে রসূলুল্লাহ (সঃ) এর প্রকৃত সহীহ হাদীসটি হল, “ উম্মুল কোরআন ছাড়া কোন সালাত নেই ।” এটি বুখারী ও মুসলিমে উল্লেখ আছে এবং যুহরী এটি মুহাম্মদ ইবনে রাবীর মাধ্যমে উবাদাহ (রঃ) থেকে বর্ণনা করেন। এই হাদীসে (২ নম্বর যা তিরমিযীতে ২য় ব্যাখায়) তিনি বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সঃ) ফজরের সালাত আদায় করলেন কিন্তু তিলাওয়াত তাঁর জন্য কষ্টকর হল, তাই সালাত শেষে তিনি বললেন, “ তোমরা ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করছিলে ! ” আমরা বললাম, “ হ্যাঁ ।” রসূলুল্লাহ (সঃ) আদেশ দিলেন, “ উম্মুল কোরআন ব্যাতীত কোন কিছু তিলাওয়াত করবে না, কারণ যে এটি তিলাওয়াত করবে না তার জন্য কোন নামায নেই ।”

এই হাদীসের শব্দগুলোর বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখে কিছু সিরিয়াবাসী ভুল করে বসে। বাস্তবতা এই যে উবাদাহ ইবনে সাবিত (রঃ)তখন বায়তুল মুকাদ্দাস এর ইমাম ছিলেন যখন তিনি এই হাদীসটি বর্ণনা করেন। সিরিয়াবাসী বিভ্রান্তিতে পড়ে (ভুল করে) এটিকে মরফূ ধরে, যেখানে এটি শুধুমাত্র উবাদাহ (রঃ) এর উপর মাওকূফ ছিল।”
(ফতওয়াহ ২৮৭ : ২৩ )

ইবনে তাইমিয়াহ যেহেতু এ রকম বলেছেন, সেহেতু এটি যেরকম সেটাকেই ধরে নিতে হবে। অতএব, এই হাদীসটি কোন প্রমাণ বা দলীল হিসেবে থাকতে পারে না।

(iv)

যদি, আমরা কিছু সময়ের জন্য এই হাদীসটিকে সহীহ বলে ধরে নিই, তাহলে রসূলুল্লাহ (সঃ) এর “ তোমরা সম্ভবত ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করছিলে ” শব্দগুলো বুঝায় যে তিনি তিলাওয়াত করাকে আদেশ দেননি, এবং তিলাওয়াত করাটি তার অনুমোদনেও হয় নি।অধিকন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁরা ইমামের পিছনে তিলাওয়াত করছিলেন কি না তখন শুধুমাত্র কিছু সাহাবীর হ্যাঁ সূচক জবাব প্রমাণ করে যে এটি সবার এবং সব সাহাবীর সাধারণ কাজ বা অভ্যাস ছিল না (অর্থাৎ সবাই তিলাওয়াত করতেন না) এবং এমনকি যারা এটি (তিলাওয়াত) করেছেন, সম্ভবত এর (তিলাওয়াত করার) নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কেক তারা অসচেতন ছিলেন।

(v)

এই হাদীসটিকে ব্যাকরণগতভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব যে, এই হাদীসটিকে মুক্তাদীর জন্য সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা জরুরীর প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো যায় না।এর কারণ হল ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে, ‘লা’ (সনদে উল্লেখিত) শব্দটি একটি নেতিবাচক অনুজ্ঞাসূচক শব্দ এবং যা যা এই নিষেধাজ্ঞা থেকে বহির্ভূত (‘ইলা’ শব্দ দ্বারা) শুধুমাত্র তাই অনুমতিযোগ্য হবে তবে তা করা বাধ্যতামূলক হবে না। যেহেতু সুরা ফাতিহা এর বহির্ভূত সেহেতু এটি নিছক অনুমতিযোগ্য হবে কিন্তু বাধ্যতামূলক হবে না। রসূলুল্লাহ (সঃ) এর প্রথম যুগে এটি কিছু সময়ের জন্য অনুমতিযোগ্য ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সাহাবারা ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা থেকে বিরত থাকলেন, হাদীস ০১ এবং ০২ এর ব্যাখ্যাতে যা বলা আছে।

০৩।

আবু হুরায়রা (রঃ) বর্ণনা করেন যে রসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “ যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল কিন্তু উম্মুল কোরআন পড়ল না, তার সালাত অপরিপূর্ণ।”

হাদীসের প্রেরক আবু হুরায়রা (রঃ) কে জিজ্ঞেস করেন, “ আমি মাঝে মাঝে ইমামের পিছনে থাকি (সুতরাং তখনও কি তিলাওয়াত করব?) ।আবু হুরায়রা (রঃ) নির্দেশ দিলেন, “ মনে মনে তিলাওয়াত করবে।” ”
(তিরমিযী শরীফ ৭১ : ১)

এই হাদীসে ২টি অংশ রয়েছে, প্রথম অংশটি হল মারফূ যেখানে রসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেই সুরা ফাতিহার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। আর দ্বিতীয় কথাটি আবু হুরায়রা (রঃ) এর। এই দ্বিতীয় অংশ থেকে ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়ার অত্যাবশ্যকতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়।

এই সনদের প্রথম অংশ ১ নং হাদীসের মত প্রায়(যা কিছু আগে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং এই বিষয়ের উপর বিভিন্ন উত্তর দেয়া হয়েছে)।অতএব, যেসব বিশ্লেষণ ওখানে করা হয়েছে তা এখানকার জন্যও প্রযোজ্য। প্রকৃত উত্তর এবং ব্যাখ্যা হলঃ ইমামের কেরাত মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট, অতএব, মুক্তাদী সুরা ফাতিহার যে বাধ্যবাধকতা আছে তা স্বয়ংক্রীয়ভাবেই পূরণ করছে।

হাদীসের ২য় অংশের ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ

(i)

এটি মওকূফ এজন্য যে আবু হুরায়রা (রঃ) এর নিজের বাণী এটি এবং রসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছ থেকে বর্ণিত না।তাই, এটি গ্রহণ করা যাবে না কারণ এটি শুধুমাত্র একটি মওকূফ সনদ, অন্য সহীহ মরফূ হাদীসগুলোর পরিপন্থী যেগুলো এই হাদীসের চেয়ে অধিকতর শ্রেয়।

(ii)

“ ফি নাফসিক ” শব্দের প্রকৃত অর্থ হল, “ মনে মনে পড় এটি, গভীরভাবে চিন্তা কর এবং মুখে উচ্চারণ কর না ।” কোন সন্দেহ নেই, যদি মুক্তাদী ইমামের তিলাওয়াত মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে, তবে সে গভীরভাবে চিন্তাও করতে থাকবে (চিন্তার মধ্যে থাকবে)।

(iii)

“ তিলাওয়াত কর এটি যখন তুমি একাকী সালাত আদায় করছ ” এই অনুবাদ বা শব্দগুলো দ্বারাও এটি প্রকাশ করা যেতে পারে, এবং একটি হাদীসে কুদসী, যেখানে একই রকম আরবী শব্দ এসেছে, এই ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে।

আল্লাহ পাক বলেন, “ যদি বান্দা আমাকে স্মরণ করে যখন সে একাকী থাকে (প্রকৃত শব্দটি হল ফি নাফসিহি), আমি তাকে স্মরণ করি একইভাবে, আর যদি সে আমাকে স্মরণ করে কোন মজলিসে (যখন অনেক মানুষ থাকে), তবে আমি তাকে এর চেয়ে বড় মজলিসে স্মরণ করি।”

কোন মজলিসে অনেক লোকের সাথে থাকার বিপরীত হল একাকী থাকা। সুতরাং, আবু হুরায়রা (রঃ) যা বলেছেন তার অর্থ দাঁড়ায়, “ শুধুমাত্র যখন তুমি আলাদাভাবে নামায আদায় করবে,তোমাকে তখন সুরা ফাতিহা অবশ্যই পড়তে হবে। ”
এভাবে, “ ফি নাসফিক ” এর অর্থ ধরে নেয়া যায় , “ যখন তুমি একাকী ।”

উপরোক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের শেষ পর্যায়ে এসে আমরা খুব সহজে এবং নিশ্চিতভাবে পরিসমাপ্তি টানতে পারি যে, হানাফীদের মতের অনুকূলে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রমাণ থাকার কারণে তাদের মতামতটা সবচেয়ে শুদ্ধ বলা যায়। কোরআনের আয়াত এবং হাদীসের আলোকে এটি স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, মুক্তাদীকে ২টি বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে হয়,যেগুলো হল তাকে চুপচাপ থাকতে হবে এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।হাদীসের আলোকে এটি পরিষ্কার যে, ইমামের কেরাতই মুক্তাদীর জন্য যথেষ্ট।
যেহেতু প্রথম আয়াতটি, যখন কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন যে কোন ধরণের শব্দ উচ্চারণ করা বা বলাকে নিষেধ করে, সেহেতু এটিকে একটি নিষেধাজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং মুক্তাদীকে পুরোপুরি নীরবতা পালন করতে হবে,সেটা সিরী নামায হোক বা জাহরী নামায হোক। এখানে আর কোন প্রশ্ন অবশিষ্ট নেই যে কেন মুক্তাদীকে সিরী নামাযে চুপচাপ থাকতে হবে যেখানে ইমামের কেরাত শুনার কোম উপায় নেই। এটি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, প্রথম আয়াতটি ২টি আদেশ প্রদান করে, তার মধ্যে একটি হল নীরবতা পালন করা যা সিরী নামাযের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

হানাফী মাযহাব এই সমস্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় আনে এবং পরিশেষে এই মতে পৌঁছে যা হাদীসের সবগুলো দিকই ব্যাখ্যা করে বা মেনে চলে, অতএব এই মতামতটিই কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও কাছাকাছি।

ধন্যবাদ সবাইকে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে বুঝার তওফীক দান করুন।আমীন। 

 Source: http://www.somewhereinblog.net 



No comments:

Post a Comment