রাফয়ে ইয়াদাইন নিয়ে কিছু কথা.............
-আবদুস সবুর খান
আজকাল কিছু ভাই রাফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে এমন কিছু কথা ছড়াচ্ছে যা সাধারন
মুসলমানদের বিভ্রান্তিতে ফেলছে। কিন্তু তারা (সাধারন মুসলমান) কুরআন ও
হাদীস সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন না এবং স্বভাবতই তারা অনেকেই বিভ্রান্তির
স্বীকার হচ্ছেন। তাই উক্ত বিষয় সম্পর্কে কিছু বলা নিজের ঈমানী দায়িত্ব
মনে করছি।
নিচে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা সম্পর্কিত দলীলগুলো পেশ করা হল :---
প্রথম দলীল : নবী স.-এর নামায
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন আমি কি তোমাদের কে হুজুর সাঃ এর নামাজ সম্পর্কে অবগতি দেব না? এ কথা বলে তিনি নামাজ পড়ে দেখালেন এবং নামাজে তাকবীরে তাহরীমার সময় একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করলেন। নামাজে আর কোথাও তিনি রফঈ ইয়াদিন করলেন না। (প্রমান: তিরমিযী ১;৩৫, সহীহ নাসায়ী শরীফ, হাদিস নং ১০৬১, প্রকাশনী- ইসঃ ফাউঃ বাংলাদেশ, প্রকাশকাল- মে, ২০০২)
মুহাদ্দিস আহমদ শাকির এ হাদীস সম্পর্কে বলেন-
“ইবনে হাযম ও অন্যান্য হাফিজুল হাদীস উপরের হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন।”
আল্লামা ইবনুত তুরকামানী (রহ) বলেন,
“এই হাদীসের সকল রাবী সহীহ মুসলিমের রাবী”
(আল-জাওহারুন নাকী : ২/৭৮)
স্মর্তব্য যে, ইমাম তিরমিযী রহ. “সুনান” গ্রন্থে ইবনুল মুবারক রহ. এর যে মন্তব্য উল্লেখ করেছেন তা এই বর্ণনা সম্পর্কে নয়, অন্য আরেকটি বর্ননা সম্পর্কে, যা নিন্মোক্ত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে-
‘রসুল স. শুধু প্রথমবার হাত উঠিয়েছেন।’
এ দুই বর্ণনার মধ্যে প্রভেদ না করায় অনেক আলেম বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন কিংবা অন্যকে বিভ্রান্ত করেছেন। (দেখুন : নাসবুর রাযাহ : ১/৩৯৪)
এজন্য সুনানে তিরমিযীর বিভিন্ন নুসখায় দ্বিতীয় বর্ণনাটি ভিন্ন শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইবনুল মুবারকের মন্তব্যও রয়েছে সেখানে। অতএব তার মন্তব্য আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে নয়।
(জামে তিরমিযী, তাহক্বীক আহমদ শাকির ২/৪১)
এখানে মুহাদ্দিস আহমদ শাকিরের পর্যালোচনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লেখেন-
‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ বিষয়ে (একশ্রেনীর মানুষ) জয়ীফ হাদীসকে সহীহ ও সহীহ হাদীসকে জয়ীফ সাব্যস্ত করার প্রয়াস পেয়ে থাকে। তাদের অধিকাংশই নীতি ও ইনসাফ বিসর্জন দিয়ে থাকে।’
দ্বিতীয় দলীল : রাফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে হাদীসের বারণ
হজরত জাবির ইবনে সামুরাহ রাঃ বলেন , নামাজের মুহুর্তে হুজুর সাঃ আমাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, “তোমাদের কি হল যে তোমাদের কে দেখতে পাচ্ছি তোমরা রাফয়ে ইয়াদাইন করছ দুর্দান্ত ঘোড়ার লেজের ন্যায়? নামাজের মধ্যে শান্ত ধীর হও। (প্রমানঃ ... আবু দাউদ ১;১০৯ নাসায়ী ১;১১৭)”
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ স. স্থিরতার সঙ্গে নামায পড়ার আদেশ দিয়েছেন। আর হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ীই যেহেতু রফইয়ে ঈয়াদিন স্থিরতা-পরিপন্থী তাই আমাদের কর্তব্য হল, নবী স.-এর নিদেশমতো স্থিরতার সঙ্গে নামায পড়া।
তৃতীয় দলীল : হযরত উমর রা.- এর আমল আসওয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
‘আমি হযরত ওমর রা.-কে দেখেছি, তিনি শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, পরে করতেন না।’ (তাহাবী: ১/১৬৪)
আল্লামা যায়লায়ী রহ. এই হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেছেন। সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী রহ. এই বর্ণনার সকল রাবীকে ‘ছিকাহ’ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। আলজাওহারুন নাকী গ্রন্থে বলা হয়েছে ‘এই হাদীসের সনদ সহীহ মুসলিমের সনদের মতো শক্তিশালী।’
ইমাম তাহাবী রহ. বলেন, ‘হযরত ওমর রা. এর আমল এবং এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর কোনরূপ বিরোধিতা না থাকায় প্রমাণ করে যে, সেই সঠিক পদ্ধতি এবং এ পদ্ধতির বিরোধিতা করা কারও জন্য উচিত নয়।’
(তাহাবী : ১/১৬৪)
চতুর্থ দলীল : হযরত আলী (রা) এর আমল
“হযরত আলী (রা) নামাযে প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন এরপর আর হাত উঠাতেন না।” (সুনানে বায়হাকী : ২/৮০)
আল্লামা যায়লায়ী রহ. বর্ণনাটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী রহ. এই বর্ণনার সকল রাবীকে ‘ছিকাহ’ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। সহীহ বুখারীর অপর ভাষ্যকার আল্লামা আইনী রহ. বলেন, “এ সনদটি সহীহ মুসলিমের সনদের সমমানের।’
(নাসবুর রায়াহ : ১/৪০৬, উমদাতুল কারী :৫/২৭৪, দিরায়াহ : ১/১১৩)
পঞ্চম দলীল : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর আমল
মুজাহিদ রহ. বলেন-
‘আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর পিছনে নামায পড়েছি। তিনি প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না।’
(তাহাবী : ১/১৬৩, ইবনে আবী শাইবা : ২/৪১৮ হাদীছ নং ২৪৬৭ [শায়খ আওয়ামা দা.বা. তাহক্বীকৃত নুসখা)
আল্লামা তুরকুমানী রহ. বলেছেন, ‘এ বর্ণনার সনদ সহীহ’
(আল-জাওহারুন নাকী)
ষষ্ঠ দলীল : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর আমল
আসওয়াদ রহ. বলেছেন-
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, এরপর আর করতেন না।’
(জামউল মাসানীদ)
সপ্তম দলীল : খুলাফায়ে রাশেদীন ও রাফয়ে ইয়াদাইন
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নামাভী রহ. খুলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা বিষয়ক বর্ণনাগুলো পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে-
‘খুলাফায়ে রাশেদীন শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। অন্য সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না।’
(আছারুস সুনান)
খুলাফায়ে রাশেদীন হলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম আ.-এর পর মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। তাঁরা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সত্যিকারের অনুসারী। রাসূলুল্লাহ স. তাদের সুন্নাহকেও নিদের সুন্নাহর মতো অনুসরণীয় ঘোষনা করেছেন। কেননা, তাদের সুন্নাহ ছিল নবীর সুন্নাহ থেকেই গৃহীত। তাই তারা যখন নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোন স্থানে হাত উঠাতেন না তখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের কাছেও নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোন স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা উত্তম। আর এটি নবী স.-এর সুন্নাহ।
অষ্টম দলীল : সাহাবায়ে কেরামের কর্মধারা
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন-
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর (রাফয়ে ইয়াদাইন না করা সংক্রান্ত) হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ে উত্তীর্ণ এবং অনেক আহলে ইলম সাহাবা-তাবেয়ীন এই মত পোষন করতেন। ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহ. ও কুফাবাসী ফকীহগণ এই ফতোয়া দিয়েছেন।
(জামে তিরমিযী : ১/৩৫)
আল্লামা ইবনে আবদুল বার রহ. রাফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান বর্ণনা করেছেন-
“হযরত হাসান রা. সাহাবায়ে কেরামের কর্মনীতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাদের মধ্যে যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন তারা রাফয়ে ইয়াদাইন পরিত্যাগকারীদের উপর আপত্তি করতেন না’।
এ থেকে বোঝা যায়, রাফয়ে ইয়াদাইন জরুরি কিছু নয়।”
(আত-তামহীদ : ৯/২২৬)
এ উদ্বৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই একাধিক কর্মধারা ছিল। কেউ নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কিছু স্থানেও রাফয়ে ইয়াদাইন করা উত্তম মনে করতেন। কেউ তা মনে করতেন না। তবে এ বিষয়ে তাদের অভিন্ন কর্মনীতি এই ছিল যে, যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন তারা অন্যদের সম্পর্কে আপত্তি করতেন না।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা এবং যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করেন না তাদেরকে আপত্তি ও সমালোচনার নিশানা বানানো প্রকারান্তরে সাহাবীদেরই নিন্দা ও সমালোচনা করা।
বলাবাহুল্য, এ শ্রেণীর মানুষ সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও পথ থেকে বিচ্যুত।
নবম দলীল : মদীনাবাসী ও রাফয়ে ইয়াদাইন উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন ইমাম মালিক রহ. জন্মগ্রহন করেন ৯৩ হিজরীতে। ইলমের অন্যতম কেন্দ্রভূমি মদীনা মুনাওয়ারায় তাঁর জীবন কেটেছে। সাহাবায়ে কেরামের আমল এবং হাদীস শরীফের বিশাল ভান্ডার তার সামনে ছিল। তিনি শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মদীনাবাসীর কর্মকে বুনিয়াদী বিষয় বলে মনে করতেন।
তাঁর প্রসিদ্ধ সাগরিত আল্লামা ইবনুল কাসিম রহ. রাফয়ে ইয়াদাইন প্রসঙ্গে তাঁর যে সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন তা এই-
“ইমাম মালিক রহ. বলেছেন, “নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য তাকবীরের সময়, নামায়ে ঝুঁকার সময় কিংবা সোজা হওয়ার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করার নিয়ম আমার জানা নাই।”
ইবনুল কাসিম রহ. আরো বলেন,
“ইমাম মলিক নামাযের প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাফয়ে ইয়াদাইন করার পদ্ধতিকে (দলীলের বিবেচনায়) দুর্বল মনে করতেন।”
(আল-মুদাওয়ানাতুল কুবরা)
দশম দলীল : ইবরাহীম নাখায়ী রহ.-এর ফতোয়া
ইবরাহীম নাখায়ী রহ. বলেন-
“নামাযের শুরু রাফয়ে ইয়াদাইন করার পর অন্য কোথায় রাফয়ে ইয়াদাইন করো না”
(জামিউস মাসানীদ : ১/৩৫৩)
সারকথা :
উপরোক্ত দালীলিক আলোচনা থেকে যে বিষয়গুলো প্রমাণিত হচ্ছে তা নিন্মরূপ:
১. নবী স.-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা সম্বলিত হাদীস থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা উত্তম।
২. রাসূলুল্লাহ স. স্ববাস-প্রবাসের সার্বক্ষণিক সহচর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, নবী স. নামাযের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, এরপর আর করতেন না।
৩. হযরত জাবির রা.-এর হাদীস থেকে জানা যায়, স্বয়ং নবী স. নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে নিষেধ করেছিলেন।
৪. দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এবং চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা. সম্পর্কে বিশুদ্ধ বর্ণনায় রয়েছে যে, তাদের কাছেও রাফয়ে ইয়াদাইন না করাই অধিক শুদ্ধ ও অগ্রগণ্য। আর এ সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীদের দ্বিমত বর্ণিত না হওয়া থেকে প্রমান হয় যে, অধিকাংশ সাহাবী এ নিয়ম অনুসরণ করতেন।
৫. খুলাফায়ে রাশেদীন নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন এমন প্রমান নেই।
৬. নবী স.-এর পুণ্যযুগের অব্যবহিত পরেই ছিল খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ। তাদের রাফয়ে ইয়াদাইন না করা প্রমান করে যে, তাদের মতেও নামাযে রাফফে ইয়াদাইন না করাই ছিল হুজুর স.-এর সর্বশেষ আমল।
৭. নামাযের ভিতরে রাফয়ে ইয়াদাইন প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের যুগেও একাধিক নিয়ম ছিল। তবে দলীল-প্রমানের আলোকে তাদের নিয়মই অগ্রগণ্য যারা রাফয়ে ইয়াদাইন না করা উত্তম মনে করতেন।
৮. সহীহ সনদে এসেছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না। তিনি রাফয়ে ইয়াদাইন প্রসঙ্গ ও তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন।
অতএব রাফয়ে ইয়াদাইন করণীয় প্রমানের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে উপর রা. ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সূত্র বর্ণিত রেওয়ায়েত উপস্থাপন করা উচিত নয়।
আল্লাহ সুবানুহুতা’য়ালা আমার কুরআন ও হাদীস মোতাবেক সহী আমল করার
এবং যারা বিভ্রান্তমূলক কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তাদের বিভ্রান্তির হাতে থেকে তাদের এবং আমাদের বাঁচার তৌফিক দান করুন। আমীন।
সহায়ক গ্রন্থ :
নবীজির নামায
ড. শাইখ মুহাম্মদ ইলিয়াস ফয়সাল
মদীনা মুনাওয়ারাহ
নিচে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা সম্পর্কিত দলীলগুলো পেশ করা হল :---
প্রথম দলীল : নবী স.-এর নামায
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন আমি কি তোমাদের কে হুজুর সাঃ এর নামাজ সম্পর্কে অবগতি দেব না? এ কথা বলে তিনি নামাজ পড়ে দেখালেন এবং নামাজে তাকবীরে তাহরীমার সময় একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করলেন। নামাজে আর কোথাও তিনি রফঈ ইয়াদিন করলেন না। (প্রমান: তিরমিযী ১;৩৫, সহীহ নাসায়ী শরীফ, হাদিস নং ১০৬১, প্রকাশনী- ইসঃ ফাউঃ বাংলাদেশ, প্রকাশকাল- মে, ২০০২)
মুহাদ্দিস আহমদ শাকির এ হাদীস সম্পর্কে বলেন-
“ইবনে হাযম ও অন্যান্য হাফিজুল হাদীস উপরের হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন।”
আল্লামা ইবনুত তুরকামানী (রহ) বলেন,
“এই হাদীসের সকল রাবী সহীহ মুসলিমের রাবী”
(আল-জাওহারুন নাকী : ২/৭৮)
স্মর্তব্য যে, ইমাম তিরমিযী রহ. “সুনান” গ্রন্থে ইবনুল মুবারক রহ. এর যে মন্তব্য উল্লেখ করেছেন তা এই বর্ণনা সম্পর্কে নয়, অন্য আরেকটি বর্ননা সম্পর্কে, যা নিন্মোক্ত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে-
‘রসুল স. শুধু প্রথমবার হাত উঠিয়েছেন।’
এ দুই বর্ণনার মধ্যে প্রভেদ না করায় অনেক আলেম বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন কিংবা অন্যকে বিভ্রান্ত করেছেন। (দেখুন : নাসবুর রাযাহ : ১/৩৯৪)
এজন্য সুনানে তিরমিযীর বিভিন্ন নুসখায় দ্বিতীয় বর্ণনাটি ভিন্ন শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ইবনুল মুবারকের মন্তব্যও রয়েছে সেখানে। অতএব তার মন্তব্য আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে নয়।
(জামে তিরমিযী, তাহক্বীক আহমদ শাকির ২/৪১)
এখানে মুহাদ্দিস আহমদ শাকিরের পর্যালোচনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি লেখেন-
‘রাফয়ে ইয়াদাইন’ বিষয়ে (একশ্রেনীর মানুষ) জয়ীফ হাদীসকে সহীহ ও সহীহ হাদীসকে জয়ীফ সাব্যস্ত করার প্রয়াস পেয়ে থাকে। তাদের অধিকাংশই নীতি ও ইনসাফ বিসর্জন দিয়ে থাকে।’
দ্বিতীয় দলীল : রাফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে হাদীসের বারণ
হজরত জাবির ইবনে সামুরাহ রাঃ বলেন , নামাজের মুহুর্তে হুজুর সাঃ আমাদের নিকট আসলেন এবং বললেন, “তোমাদের কি হল যে তোমাদের কে দেখতে পাচ্ছি তোমরা রাফয়ে ইয়াদাইন করছ দুর্দান্ত ঘোড়ার লেজের ন্যায়? নামাজের মধ্যে শান্ত ধীর হও। (প্রমানঃ ... আবু দাউদ ১;১০৯ নাসায়ী ১;১১৭)”
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ স. স্থিরতার সঙ্গে নামায পড়ার আদেশ দিয়েছেন। আর হাদীসের বক্তব্য অনুযায়ীই যেহেতু রফইয়ে ঈয়াদিন স্থিরতা-পরিপন্থী তাই আমাদের কর্তব্য হল, নবী স.-এর নিদেশমতো স্থিরতার সঙ্গে নামায পড়া।
তৃতীয় দলীল : হযরত উমর রা.- এর আমল আসওয়াদ রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
‘আমি হযরত ওমর রা.-কে দেখেছি, তিনি শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, পরে করতেন না।’ (তাহাবী: ১/১৬৪)
আল্লামা যায়লায়ী রহ. এই হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেছেন। সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী রহ. এই বর্ণনার সকল রাবীকে ‘ছিকাহ’ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। আলজাওহারুন নাকী গ্রন্থে বলা হয়েছে ‘এই হাদীসের সনদ সহীহ মুসলিমের সনদের মতো শক্তিশালী।’
ইমাম তাহাবী রহ. বলেন, ‘হযরত ওমর রা. এর আমল এবং এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর কোনরূপ বিরোধিতা না থাকায় প্রমাণ করে যে, সেই সঠিক পদ্ধতি এবং এ পদ্ধতির বিরোধিতা করা কারও জন্য উচিত নয়।’
(তাহাবী : ১/১৬৪)
চতুর্থ দলীল : হযরত আলী (রা) এর আমল
“হযরত আলী (রা) নামাযে প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন এরপর আর হাত উঠাতেন না।” (সুনানে বায়হাকী : ২/৮০)
আল্লামা যায়লায়ী রহ. বর্ণনাটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন। সহীহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যকার আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী রহ. এই বর্ণনার সকল রাবীকে ‘ছিকাহ’ (নির্ভরযোগ্য) বলেছেন। সহীহ বুখারীর অপর ভাষ্যকার আল্লামা আইনী রহ. বলেন, “এ সনদটি সহীহ মুসলিমের সনদের সমমানের।’
(নাসবুর রায়াহ : ১/৪০৬, উমদাতুল কারী :৫/২৭৪, দিরায়াহ : ১/১১৩)
পঞ্চম দলীল : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর আমল
মুজাহিদ রহ. বলেন-
‘আমি আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর পিছনে নামায পড়েছি। তিনি প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্য সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না।’
(তাহাবী : ১/১৬৩, ইবনে আবী শাইবা : ২/৪১৮ হাদীছ নং ২৪৬৭ [শায়খ আওয়ামা দা.বা. তাহক্বীকৃত নুসখা)
আল্লামা তুরকুমানী রহ. বলেছেন, ‘এ বর্ণনার সনদ সহীহ’
(আল-জাওহারুন নাকী)
ষষ্ঠ দলীল : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর আমল
আসওয়াদ রহ. বলেছেন-
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, এরপর আর করতেন না।’
(জামউল মাসানীদ)
সপ্তম দলীল : খুলাফায়ে রাশেদীন ও রাফয়ে ইয়াদাইন
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নামাভী রহ. খুলাফায়ে রাশেদীনের কর্মধারা বিষয়ক বর্ণনাগুলো পর্যালোচনা করে এ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে-
‘খুলাফায়ে রাশেদীন শুধু প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। অন্য সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন বলে প্রমান পাওয়া যায় না।’
(আছারুস সুনান)
খুলাফায়ে রাশেদীন হলেন আম্বিয়ায়ে কেরাম আ.-এর পর মানবজাতির মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী। তাঁরা ছিলেন রাসূলুল্লাহর সত্যিকারের অনুসারী। রাসূলুল্লাহ স. তাদের সুন্নাহকেও নিদের সুন্নাহর মতো অনুসরণীয় ঘোষনা করেছেন। কেননা, তাদের সুন্নাহ ছিল নবীর সুন্নাহ থেকেই গৃহীত। তাই তারা যখন নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোন স্থানে হাত উঠাতেন না তখন একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের কাছেও নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোন স্থানে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা উত্তম। আর এটি নবী স.-এর সুন্নাহ।
অষ্টম দলীল : সাহাবায়ে কেরামের কর্মধারা
ইমাম তিরমিযী রহ. বলেন-
‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর (রাফয়ে ইয়াদাইন না করা সংক্রান্ত) হাদীস ‘হাসান’ পর্যায়ে উত্তীর্ণ এবং অনেক আহলে ইলম সাহাবা-তাবেয়ীন এই মত পোষন করতেন। ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহ. ও কুফাবাসী ফকীহগণ এই ফতোয়া দিয়েছেন।
(জামে তিরমিযী : ১/৩৫)
আল্লামা ইবনে আবদুল বার রহ. রাফয়ে ইয়াদাইন সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের অবস্থান বর্ণনা করেছেন-
“হযরত হাসান রা. সাহাবায়ে কেরামের কর্মনীতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘তাদের মধ্যে যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন তারা রাফয়ে ইয়াদাইন পরিত্যাগকারীদের উপর আপত্তি করতেন না’।
এ থেকে বোঝা যায়, রাফয়ে ইয়াদাইন জরুরি কিছু নয়।”
(আত-তামহীদ : ৯/২২৬)
এ উদ্বৃতি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই একাধিক কর্মধারা ছিল। কেউ নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কিছু স্থানেও রাফয়ে ইয়াদাইন করা উত্তম মনে করতেন। কেউ তা মনে করতেন না। তবে এ বিষয়ে তাদের অভিন্ন কর্মনীতি এই ছিল যে, যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন তারা অন্যদের সম্পর্কে আপত্তি করতেন না।
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা এবং যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করেন না তাদেরকে আপত্তি ও সমালোচনার নিশানা বানানো প্রকারান্তরে সাহাবীদেরই নিন্দা ও সমালোচনা করা।
বলাবাহুল্য, এ শ্রেণীর মানুষ সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও পথ থেকে বিচ্যুত।
নবম দলীল : মদীনাবাসী ও রাফয়ে ইয়াদাইন উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন ইমাম মালিক রহ. জন্মগ্রহন করেন ৯৩ হিজরীতে। ইলমের অন্যতম কেন্দ্রভূমি মদীনা মুনাওয়ারায় তাঁর জীবন কেটেছে। সাহাবায়ে কেরামের আমল এবং হাদীস শরীফের বিশাল ভান্ডার তার সামনে ছিল। তিনি শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে মদীনাবাসীর কর্মকে বুনিয়াদী বিষয় বলে মনে করতেন।
তাঁর প্রসিদ্ধ সাগরিত আল্লামা ইবনুল কাসিম রহ. রাফয়ে ইয়াদাইন প্রসঙ্গে তাঁর যে সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন তা এই-
“ইমাম মালিক রহ. বলেছেন, “নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য তাকবীরের সময়, নামায়ে ঝুঁকার সময় কিংবা সোজা হওয়ার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করার নিয়ম আমার জানা নাই।”
ইবনুল কাসিম রহ. আরো বলেন,
“ইমাম মলিক নামাযের প্রথম তাকবীর ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে রাফয়ে ইয়াদাইন করার পদ্ধতিকে (দলীলের বিবেচনায়) দুর্বল মনে করতেন।”
(আল-মুদাওয়ানাতুল কুবরা)
দশম দলীল : ইবরাহীম নাখায়ী রহ.-এর ফতোয়া
ইবরাহীম নাখায়ী রহ. বলেন-
“নামাযের শুরু রাফয়ে ইয়াদাইন করার পর অন্য কোথায় রাফয়ে ইয়াদাইন করো না”
(জামিউস মাসানীদ : ১/৩৫৩)
সারকথা :
উপরোক্ত দালীলিক আলোচনা থেকে যে বিষয়গুলো প্রমাণিত হচ্ছে তা নিন্মরূপ:
১. নবী স.-এর শিক্ষা ও নির্দেশনা সম্বলিত হাদীস থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন না করা উত্তম।
২. রাসূলুল্লাহ স. স্ববাস-প্রবাসের সার্বক্ষণিক সহচর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউস রা.-এর সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, নবী স. নামাযের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, এরপর আর করতেন না।
৩. হযরত জাবির রা.-এর হাদীস থেকে জানা যায়, স্বয়ং নবী স. নামাযে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে নিষেধ করেছিলেন।
৪. দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এবং চতুর্থ খলীফা হযরত আলী রা. সম্পর্কে বিশুদ্ধ বর্ণনায় রয়েছে যে, তাদের কাছেও রাফয়ে ইয়াদাইন না করাই অধিক শুদ্ধ ও অগ্রগণ্য। আর এ সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীদের দ্বিমত বর্ণিত না হওয়া থেকে প্রমান হয় যে, অধিকাংশ সাহাবী এ নিয়ম অনুসরণ করতেন।
৫. খুলাফায়ে রাশেদীন নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন এমন প্রমান নেই।
৬. নবী স.-এর পুণ্যযুগের অব্যবহিত পরেই ছিল খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ। তাদের রাফয়ে ইয়াদাইন না করা প্রমান করে যে, তাদের মতেও নামাযে রাফফে ইয়াদাইন না করাই ছিল হুজুর স.-এর সর্বশেষ আমল।
৭. নামাযের ভিতরে রাফয়ে ইয়াদাইন প্রসঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের যুগেও একাধিক নিয়ম ছিল। তবে দলীল-প্রমানের আলোকে তাদের নিয়মই অগ্রগণ্য যারা রাফয়ে ইয়াদাইন না করা উত্তম মনে করতেন।
৮. সহীহ সনদে এসেছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. নামাযের সূচনা ছাড়া অন্য সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন না। তিনি রাফয়ে ইয়াদাইন প্রসঙ্গ ও তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন।
অতএব রাফয়ে ইয়াদাইন করণীয় প্রমানের জন্য আবদুল্লাহ ইবনে উপর রা. ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সূত্র বর্ণিত রেওয়ায়েত উপস্থাপন করা উচিত নয়।
আল্লাহ সুবানুহুতা’য়ালা আমার কুরআন ও হাদীস মোতাবেক সহী আমল করার
এবং যারা বিভ্রান্তমূলক কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তাদের বিভ্রান্তির হাতে থেকে তাদের এবং আমাদের বাঁচার তৌফিক দান করুন। আমীন।
সহায়ক গ্রন্থ :
নবীজির নামায
ড. শাইখ মুহাম্মদ ইলিয়াস ফয়সাল
মদীনা মুনাওয়ারাহ
No comments:
Post a Comment