Thursday, July 25, 2013

ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চলছে

ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চলছে



-মাওলানা মুহাম্মদ রূহুল আমীন খান
 
ইসলামী উম্মাহ্ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইসলামের দুশমন সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম জাহানব্যাপী চালিয়ে যাচ্ছে প্রলয় তান্ডব। কামানের গোলায়, বোমার বিস্ফোরণে, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বহু যত্নে গড়ে তোলা স্থাপনা, নগর, বন্দর, শহর জনপদ। জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। বইছে রক্ত-বন্যা। নিহত হচ্ছে সম্ভাবনাময় হাজারো তরুণ। স্বজনহারাদের আহাজারি মাতমে ভারী হয়ে গেছে আকাশ-বাতাস। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উন্নতি সমৃদ্ধির পানে দ্রুত ধাবমান অঞ্চলগুলো ধ্বংসসূতপে পরিণত হচ্ছ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে, লুণ্ঠন অব্যাহত রাখতে অবলম্বন করে চলছে নিত্য নতুন কৌশল। চালিয়ে যাচ্ছে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। তারাসর্প হয়ে দংশন করছে আবার ওঝা হয়ে আসছে ঝাড়ছে তারা গাছেরটা যেমনে খাচ্ছে তলারটাও তেমনি কুড়োচ্ছে। তাদেরই আগ্রাসহামলায়, ইবলিসী ষড়যন্ত্রে ইরাক আজ ধ্বংস্তূপে পরিণত। আফগানিস্তান পোড়ামাটির দেশ। জ্বলছে ফিলিস্তিন। পাকিস্তান রক্তাক্ত। পশ্চিম এশিয়া আফ্রিকার দেশে দেশে বীভৎস ধ্বংসলীলা। কূট কৌশলে তারা সক্ষম হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে, পরস্পরে দুশমনী সৃষ্টি করতে, এক গ্রুপকে আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে সংঘাত, সংঘর্ষ লড়াইয়ে লিপ্ত করতে। এটাই ওদের পরম সাফল্য আর আমাদের চরম ব্যর্থতা।
আজ আমরাই লড়ছি আমাদের বিরুদ্ধে, আমরাই হত্যা করছি আমাদের ভাইকে। আমরাই ধ্বংস করছি আমাদের সম্পদ। মুসলমান ভাইয়ের জানাজা যাত্রায় আক্রমণ করছে মুসলমাননরা। চড়াও ইচ্ছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। হামলা চালাচ্ছে মসজিদে। হত্যা করছে নামাজরত মুসল্লিদের। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, এর অনেকটাই করা হচ্ছে ধর্মের নামে দ্বীনি খিদমতের মুখোশে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশেও শুরু হয়ে গেছে সেই মরণ খেলার আবহ।
ফিতনা হত্যার চেয়েও মারাত্মক। মুসলমানদের ঐক্য-সংহতি, বিনষ্ট করা, সুকৌশলে এককে অপরের দুশমন করে তোলা, দ্বন্দ্ব সংঘাতের বীজ বপন করা, ধর্মীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমজনতার সামনে নিয়ে আসা, বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে আলোচ্য একাডেমিক বিষয়গুলোকে ফরজ-ওয়াজিব বিষয়গুলো থেকেও রাধান্য দিয়ে সাধারণের মধ্যে প্রচারে লিপ্ত হয়ে হয়ে ফিরকাবাজিতে মশগুল হওয়া- সবই বিধ্বংসী কাজের আলামত। কাজে যারা মশগুল তাদের নিরস্ত হওয়া দরকার, নিরস্ত করা দরকার। তারা ভেবে দেখেন কিনা জানি না, অজ্ঞতার জন্য হোক, অদূরদর্শিতার জন্য হোক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোক তারা দ্বীনের খিদমতের নামে দ্বীনের ক্ষতিই করে চলছেন। এতোদিন এসব আলোচনা ওয়াজে বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাপী, সর্বত্র সবখানে। এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে সব জায়গায়। সাধারণ মানুষ, ইসলামী শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষ যাদের কুরআন, হাদীস, ফিক্হের জ্ঞান অর্জন করা তো দূরের কথা আরবি অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই এমন লোকেরাও যখন বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ দক্ষ, মুহাক্কিক আলেম ওলামাদের বলতে শুরু করেছে, হুজুর! আপনার মাসআলাটি শুদ্ধ নয়, আপনার নামাজের পদ্ধতি কুরআন-হাদীস মোতাবেক নয়, আপনার রোজা, হজ্ব, যাকাত সম্পর্কিত তালীম মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এর বাতানো, শিখানো, নির্দেশিত শিক্ষার বিপরীত, হাদীস বিরোধী ইত্যাদি বলার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে তখন তাকে ফিতনা না বলে আর কীইবা বলা যেতপারে! অনেক জায়গায়ই দেখা গেছে এবং বহু জায়গা থেকে সংবাদ পাওয়া গেছে, এসব নিয়ে ব্যাপক বচসা শুরু হয়েছে। এমনকি সংঘাত-সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। মিডিয়ার প্রচারণায় বিভ্রান্ত দ্বীনি ইলমে মুর্খ শ্রোতাদের মধ্যে অনেকে আবার বলতে শুরু করেছে, তোমাদের ধর্মীয় কিতাব তো রআন-হাদীস নয়, ফিক্হ। তোমরা আসলে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উম্মতও নও, আবু হানিফার (রা.) উম্মত। ওই সেইবাবু যাহা বলে পরিষদ দলে বলে তার শতগুণ অনেকে বলেন, অমুক মিডিয়ার, অমুক হুজুর বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা হাদীস জানতেন না, কেউ কেউ বলছেন, তিনি মাত্র ১২ খানা হাদীস জানতেন। কাজেই কুরআন-হাদীস বাদ দিয়ে যারা তার মাজহাবের অনুসরণ করবে তারা আল্লাহ্-রাসূলকে পাবে না। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। কী মারাত্মক কথা! কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া! সাধারণ মানুষদের এমন সব কথা বলার জন্য পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করল কারা? আলেম-উলামাদের প্রতি এই অবিশ্বাস-অনাস্থা সৃষ্টি করার জন্য দায়ী কারা? ধারা যদি অব্যাহত থাকে তবে তার পরিণতি কোথায় গিয়ে গড়াবে! চরমপন্থী, উগ্রপন্থী লোক বিভিন্ন মতের অনুসারীদের মধ্যে থাকে। তারা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, যদি সংঘাতে লিপ্ত হয় তবে পাকিস্তানের মতো আত্মঘাতী লড়াই শুরহয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কি উড়িয়ে দেয়া যায়?
ওরা প্রচার চালাচ্ছে তোমাদের নামাজ মুহাম্মদী নামাজ নয়, হানাফী নামাজ। হানাফী আর মুহাম্মদী নামাজে নামাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে তারা। এদেশে মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ লোক সুন্নী হানাফী। হানাফী উস্তাদই বাল্যকালে নামাজ শিখিয়েছেন তাদেরকে। নিম্ন শ্রেণী থেকে সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত সকল মাদরাসায় হানাফী ফিক্হ পাঠ্য তালিকাভূক্ত। পীর মাশায়েখ, ওয়ায়েজ, মুবাল্লিগ, আলেম-উলামা, মাদরাসার উস্তাদগণ প্রায় সবাই হানাফী। তারা সবাই কি হাদীসের বিপরীত ভুল নামাজের তালীম দিয়েছেন? বিভিন্ন মাসআলা শিক্ষা দিচ্ছেন? ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, সমরখন্দ, বোখারা, দাঘিস্তান, চেচনিয়া, ইঙ্গুশতিয়া, খোতওয়ান, তুরস্কের প্রায় সব মুসলমান হানাফী ফিক্হে অনুসারী। আরব জাহান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের মধ্যেও হানাফী ফিক্হের অনুসারীর সংখ্যা কম নয়। হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে বিশ্বের সহস্র সহস্র মুহাদ্দিস, মুফাসসীর, ফকিহ, ইমাম, উলামায়ে দ্বীন অনুসরণ করে আসছেন যে ফিক্হের, যে ইমামে আজমের, সেই ইমামই ছিলেন হাদীস শাস্ত্রে অজ্ঞ! উনারা প্রতিদিন প্রচার করে যাচ্ছেন, সাজানো প্রশ্নকর্তার প্রহসনমূলক প্রশ্নের উত্তরে বলে যাচ্ছেন ইমামের পিছনে মুক্তাদি কেরাত তথা সূরা ফাতিহা না পড়লে নামাজই হবে না, অর্থা নামাজ পড়া সত্ত্বেও হবে বেনামাজি, এর চেয়ে চরম ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে! ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা, কেরাত পড়ার যেমন হাদীস আছে তেমনি না পড়ারও হাদীস আছে, বিশিষ্ট সাহাবীগণের আমল উভয় দিকেই আছে, রাসূলে পাক (সা.)-এর জমানা হতে আজ পর্যন্ত দুধরনের আমলই জারি আছে। ফকিহ সাহাবীদের, তাবেঈন, তাবেতাবেঈন, ইমাম মুজহাতিদদের নামাজ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার, বাতিল অশুদ্ধ বলে অপপ্রচার চালানোর অধিকার কোথা থেকে পেলেন তারা? নিজেদের সুবিধামত হাদীসটিই তারা বলেন ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের ফাতিহা, কেরাত না পড়ার, রাফে ইয়াদাইন না করার, আমীন জোরে না বলার অসংখ্য হাদীস রয়েছে তার উল্লেখ করেন না ভুলক্রমেও। সে হাদীস সমূহ অস্বীকার অগ্রাহ্য করে এই যে অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা কোন ধরনের দ্বীনি খিদমত? যারা বেনামাজি তাদের নামাজি বানানোই তো ছিল দায়িত্ব, যারা নামাজ পড়ছেন তাদের সংশয়ে, সন্দেহে নিক্ষেপ করা তো দ্বীনি খিদমত হতে পারে না। বাংলাদেশের শত সহস্র মাদরাসার উচ্চ শ্রেণীসমূহে যেমন ফিক্হ পড়ানো হয় তেমনি অত্যন্ত শুরুত্বের সাথে সহীহ হাদীসের গ্রন্থসমূহ, সিহাহ্ সিত্তাহ অন্য হাদীস গ্রন্থ পড়ানো হয়। তাই উনারাই হাদীসবেত্তা অন্যরা হাদীস পড়ে না, জানে না, আমল করে না এমনটা ভাবা আহাম্মুকী বৈ কিছুই নয়।
ইসলামী জ্ঞান, আইন, শরীয়তের মূল ৎসই কুরআন হাদীস। কুরআন হাদীস উভয়ই ওহী। একটি ওহীয়ে মতলু আর একটি ওহীয়ে গায়ের মতলু। হাদীসকে বাদ দিলে দ্বীনের অস্তিত্বই থাকে না। তাই সকল আলেমেদ্বীনই হাদীস মানেন, হাদীস জানেন এবং হাদীস মোতাবেকই আমল করেন। হাদীস কারোর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, সকল মুসলমানই আহলে কুরআন, সকল মুসলমানই আহলে হাদীস। কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রামাণিত, প্রিয় নবীর (সা.) আমলে সাহাবী, তাবেঈনদের মাধ্যমে পরস্পরায় প্রাপ্ত, ইজমায়ে উম্মাহর দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত সর্বসম্মত মাসআলা যেন তেন শাজ মুনকার হাদীস আউড়িয়ে উড়িয়ে দিয়ে যে কাজটি করা হচ্ছে তারই নাম ফিতনা। ফিতনা সৃষ্টি থেকে, ভ্রান্তবিচ্যুত রেওয়ায়েত পেশ করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপতৎপরতা থেকে তাদের এখনই বিরত হওয়া আবশ্যক। আমাদের আহবান, বিরত হোন। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াবেন না, আপনি আপনার অনুগামী অনুসারী ছাড়া অন্য সবাই ভ্রান্ত, এমন দাম্ভিক উক্তি প্রচারণার ফল কখনই ভালো হতে পারে না।
ইসলামের পথ সংকীর্ণ নয়, কণ্টকিত নয়, প্রশস্ত মসৃণ। ইলমে হাদীসের পরিসরও বিশাল। তারপরও যুগের আবর্তনে সৃষ্ট নিত্য নতুন সমস্যার সমাধানে ইজমা কিয়াসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ইমাম মুজতাহিদগণ কুরআন, হাদীসের ভান্ডার সামনে রেখে, ইজমায়ে উম্মত কিয়াসের ভিত্তিতে চলার পথ সুগম করার জন্য ইসলামী আইন-কানুন বিধি-বিধানের যে সুবিন্যস্ত শাস্ত্র উম্মতকে উপহার দিয়েছেন তারই নাম ফিকহ। যারা ফিকহের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন তারাও নামাজ শিখেছেন ফিকাহ্ থেকেই। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা আবদুল মালিকেরনবীজির নামাজগ্রন্থের ভূমিকায় লেখা বক্তব্যটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : ‘যদি অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের পরে এবং শিশুকে বালিগ হওয়ার পর বাধ্য করা হতো যে, তোমাদেরকে নামাজ আদায়ের পদ্ধতি হাদীসের কিতাব থেকে শিখতে হবে, কারো তাকলীদ করতে পারবে না, দলিল প্রমাণের আলোকে সকল বিষয় নিজে পরীক্ষা করে নামাজ পড়বে। তাহলে বছরের পর বছর অতিবাহিত হবকিন্তু নামাজ পড়ার সুযোগ হবে না। একই অবস্থা হবে যদি সাধারণ মানুষকে এই আদেশ করা হয়। খুব ভালো করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন যে, কুতুবে সিত্তা বুখারী, মুসলিম, আবুদাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থের সংকলক ইমামগণও প্রথমে নামাজ শিখেছেন িকহে ইসলামী থেকেই।’ ‘গোটা নামাজের পদ্ধতি ধারাবাহিকভাবে কোন এক হাদীসে নেই। পূর্ণ নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম হাদীসের এক-দুই কিতাব নয়, ছয় বা দশ কিতাবেও বিদ্যমান নেই।নামাজের পদ্ধতি শুধু মৌখিক আলোচনার মধ্য দিয়ে শেখা যায় না। সঠিক পদ্ধতিতে সহিহ শুদ্ধভাবে নামাজ আদায় করা শিখতে হয় নামাজ আদায়কারীর নামাজ দেখে। সাহাবায়ে কেরাম শিখেছেন নবীজি (সা.)-এর নামাজ দেখে। তাবেয়ীরা শিখেছেন সাহাবায়ে কেরামের নামাজ দেখে। এভাবে যুগ পরম্পরায় চলে এসেছে আজ পর্যন্ত। আবার সাহাবায়ে কেরামের দেখা শেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। বিজ্ঞতায় প্রজ্ঞায় মর্যদায় তাদের সবাই এক সমান যেমন ছিলেন না তেমনি সর্বক্ষণ নবীজির সঙ্গে থেকে নামাজ আদায় করার সৌভাগ্য লাভ করেননি অনেকেই? আলোচনার সময় এসব তুলে ধরা দরকার। পক্ষের বিপক্ষের সব দলিলই পেশ করা দরকার। কিন্তু বিভিন্ন চ্যানেলে ধর্মীয় প্রশ্নোত্তর পর্বে মতলববাজদের দেখা যায়, কেবল নিজের গরজেরটাই বলে যান অন্য রেওয়ায়েত যে আছে তার ধারও ধারেন না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেদিন এক টিভি চ্যানেলে জনৈক উত্তরদাতাকে প্রশ্নোত্তরে বলতে শুনলাম : তাকবীর তাহরিমা ছাড়া নামাজের অন্য কিছু তাকবীরে রফয়ে ইয়াদাইন করতে হবে। এটাই সুন্নত তরিকা। এটা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর হাদীস থেকে প্রমাণিত। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর পিতা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রা), ৪র্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ), (নবীজির পরিবারের আহলে বাইতের সাথে দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করার জন্য অনেকে যাকে আহলে বাইতের সদস্য বলে ধারণকরতেন সেই) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের এক বিরাট দল যে তাকবীর তাহরিমা ছাড়া রফয়ে ইয়াদাইন করতেন না এসব হাদীসের ধারেকাছেও গেলেন না। ইমামের পিছনে মুক্তাদির সূরা ফাতিহা কেরাত না পড়া, রফয়ে ইয়াদাইন না করা, আমীন জোরে না বলা ইত্যাদি হানাফীদের আমলগুলোও যে সুন্নতসম্মত, এর সমর্থনেও যে অনেক সহীহ্ হাদীস রয়েছে মতলববাজ মুফতীরা তার উল্লেখ তো করেনই না বরং হানাফীদের নামাজের সাথে নবী (সা.)-এর নামাজের মিল নেই, সম্পর্ক নেই এমন কথাই তাদের বলতে শোনা যায়। আসলে, উদ্দেশ্য তাদের সহীহ মাসয়ালা শেখানো নয়, উদ্দেশ্য উম্মাহ্র মধ্যে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা।
অবস্থায় হানাফী উলামাদের ফিতনা-ফাসাদের মোকাবেলায় অগ্রসর হওয়া উচিত। মতলববাজরা যেসব আমলকে শিরক-বিদাত, হাদীসবিরোধী, ভিত্তিহীন, বাতিল বলে অপপ্রচার চালাছে তার মোকাবেলায় দলীল প্রমাণ তুলে ধরা দরকার। কুরআন সুন্নার মজবুত ভিত্তির ওপর যে মাজহাব প্রতিষ্ঠিত মসজিদে মসজিদে, মাহফিলে মাহফিলে তা পেশ করা অবশ্যক। যেটা শিরক, যেটা ঘৃণিত বিদাত যেটা ইসলাম গর্হিত কুসংস্কার অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে। কিন্তু যেটা সুন্নাত সমর্থিত, যেসব মাসআলা দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং যে এলাকার লোক এমন সহীহ মাসয়ালার ওপর আমল করে সেখানে অন্যমত থাকলেও তা অতি ৎসাহে প্রচারণা না করাই নিয়ম। এর দ্বারা কেবল আওয়ামের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
ইসলামী আইনের মূল ৎস কুরআন-হাদীস হওয়া সত্ত্বেও তা অভীক্ষ অবেক্ষণে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। এজন্য কিছু কিছু শাখা মাসায়লে ইখতিলাফ হওয়া, থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা হয়ে আসছে, হতে থাকবে। ইখতিলাফ বা মতপার্থক্যতে দোষণীয় কিছু নেই। দোষ হচ্ছে ইখতিলাফকে মুখালাফাতে পরিণত করায়। দোষ হচ্ছে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াসের দলীলে সমৃদ্ধ মাসআলা মাসায়িল, যার ওপরে এদেশের প্রায় সব মুসলমানের আমল জারি রয়েছে সেগুলোকে বেআসল, বেবুনিয়াদ বলে মিথ্যা প্রচারণায়। দোষ হচ্ছে মসনুন বিষয়গুলোকে শিরক বিদাত, মনগড়া, বানোয়াট আখ্যায়িত করায়। এসব কাজ ধ্বংসাত্মক।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় ব্যাপারে সহিষ্ণু। বাংলাদেশের মানুষ উলামা-মাশায়েখদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের সাথে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ যুগপরস্পরায়, বংশপরস্পরায় পরম আস্থা বিশ্বাসের সাথে নির্বিঘ্নে নিরুপদ্রবে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে নামাজ, রোজা, ইবাদত বন্দেগী করে আসছে। এই স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ বিনষ্ট করার অপপ্রয়াসে যারা লিপ্ত হয়েছে, সংশয় সন্দেহ অবিশ্বাস অনাস্থার বীজ যারা বপন করে চলছে তারা কাদের প্রয়োজন পূরণ করছে? দেশকে ধর্মীয় সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যারা তাদের মতলব কি? উদ্দেশ্য কি? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, হাজার হাজার মুহাক্কিক আলেমকে সুকৌশলে ভ্রান্ত বিদাতী বলার দুঃসাহস, কোটি কোটি মুসলমানের সহীহ শুদ্ধ নামাজকে অশুদ্ধ বলার ধৃষ্টতা, সুন্নাত তরিকা অনুযায়ী তাদের আকিদা আমলকে শিরক বিদাত বাতিল বলে অপপ্রচার চালানোর ঔদ্ধত্য উনারা পেলেন কোত্থেকে? কোন্ খুঁটির জোরে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতিদিন হেনে চলছে আঘাতের পর আঘাত? তা নির্ণীত হওয়া আবশ্যক। যে মুহূর্তে উম্মাহ্র ঐক্য সংহতি সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেই মুহূর্তে ফিতনা-ফাসাদের দ্বার যারা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে, সংঘাতের দিকে জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা আসলে কাদের ? এটা ভাববার সময় এসেছে। ফিতনা নয়, ফাসাদ নয়, কুরআন-হাদীসের দলীল-প্রমাণ দিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে হবে।

সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, অক্টোবর, ২০১১ইং ঢাকা।

ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আড়ালে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চলছে

মাওলানা মুহাম্মদ রূহুল আমীন খান
ইসলামী উম্মাহ্ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ইসলামের দুশমন সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম জাহানব্যাপী চালিয়ে যাচ্ছে প্রলয় তান্ডব। কামানের গোলায়, বোমার বিস্ফোরণে, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বহু যত্নে গড়ে তোলা স্থাপনা, নগর, বন্দর, শহর ও জনপদ। জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। বইছে রক্ত-বন্যা। নিহত হচ্ছে সম্ভাবনাময় হাজারো তরুণ। স্বজনহারাদের আহাজারি ও মাতমে ভারী হয়ে গেছে আকাশ-বাতাস। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উন্নতি ও সমৃদ্ধির পানে দ্রুত ধাবমান অঞ্চলগুলো ধ্বংসসূতপে পরিণত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখতে, লুণ্ঠন অব্যাহত রাখতে অবলম্বন করে চলছে নিত্য নতুন কৌশল। চালিয়ে যাচ্ছে ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। তারা ‘সর্প হয়ে দংশন করছে আবার ওঝা হয়ে আসছে ঝাড়ছে’। তারা গাছেরটা যেমনে খাচ্ছে তলারটাও তেমনি কুড়োচ্ছে। তাদেরই আগ্রাসী হামলায়, ইবলিসী ষড়যন্ত্রে ইরাক আজ ধ্বংস্তূপে পরিণত। আফগানিস্তান পোড়ামাটির দেশ। জ্বলছে ফিলিস্তিন। পাকিস্তান রক্তাক্ত। পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে বীভৎস ধ্বংসলীলা। কূট কৌশলে তারা সক্ষম হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করতে, পরস্পরে দুশমনী সৃষ্টি করতে, এক গ্রুপকে আরেক গ্রুপের বিরুদ্ধে সংঘাত, সংঘর্ষ ও লড়াইয়ে লিপ্ত করতে। এটাই ওদের পরম সাফল্য আর আমাদের চরম ব্যর্থতা।
আজ আমরাই লড়ছি আমাদের বিরুদ্ধে, আমরাই হত্যা করছি আমাদের ভাইকে। আমরাই ধ্বংস করছি আমাদের সম্পদ। মুসলমান ভাইয়ের জানাজা যাত্রায় আক্রমণ করছে মুসলমাননরা। চড়াও ইচ্ছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। হামলা চালাচ্ছে মসজিদে। হত্যা করছে নামাজরত মুসল্লিদের। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, এর অনেকটাই করা হচ্ছে ধর্মের নামে দ্বীনি খিদমতের মুখোশে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশেও শুরু হয়ে গেছে সেই মরণ খেলার আবহ।
ফিতনা হত্যার চেয়েও মারাত্মক। মুসলমানদের ঐক্য-সংহতি, বিনষ্ট করা, সুকৌশলে এককে অপরের দুশমন করে তোলা, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের বীজ বপন করা, ধর্মীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমজনতার সামনে নিয়ে আসা, বিশেষজ্ঞ আলেমদের মধ্যে আলোচ্য একাডেমিক বিষয়গুলোকে ফরজ-ওয়াজিব বিষয়গুলো থেকেও প্রাধান্য দিয়ে সাধারণের মধ্যে প্রচারে লিপ্ত হয়ে হয়ে ফিরকাবাজিতে মশগুল হওয়া- সবই বিধ্বংসী কাজের আলামত। এ কাজে যারা মশগুল তাদের নিরস্ত হওয়া দরকার, নিরস্ত করা দরকার। তারা ভেবে দেখেন কিনা জানি না, অজ্ঞতার জন্য হোক, অদূরদর্শিতার জন্য হোক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোক তারা দ্বীনের খিদমতের নামে দ্বীনের ক্ষতিই করে চলছেন। এতোদিন এসব আলোচনা ওয়াজে বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ ছিল। এখন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বা ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাপী, সর্বত্র সবখানে। এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে সব জায়গায়। সাধারণ মানুষ, ইসলামী শিক্ষা-বঞ্চিত মানুষ যাদের কুরআন, হাদীস, ফিক্হের জ্ঞান অর্জন করা তো দূরের কথা আরবি অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত নেই এমন লোকেরাও যখন বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ দক্ষ, মুহাক্কিক আলেম ওলামাদের বলতে শুরু করেছে, হুজুর! আপনার মাসআলাটি শুদ্ধ নয়, আপনার নামাজের পদ্ধতি কুরআন-হাদীস মোতাবেক নয়, আপনার রোজা, হজ্ব, যাকাত সম্পর্কিত তালীম মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এর বাতানো, শিখানো, নির্দেশিত শিক্ষার বিপরীত, হাদীস বিরোধী ইত্যাদি বলার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে তখন তাকে ফিতনা না বলে আর কীইবা বলা যেতে পারে! অনেক জায়গায়ই দেখা গেছে এবং বহু জায়গা থেকে সংবাদ পাওয়া গেছে, এসব নিয়ে ব্যাপক বচসা শুরু হয়েছে। এমনকি সংঘাত-সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। মিডিয়ার প্রচারণায় বিভ্রান্ত দ্বীনি ইলমে মুর্খ শ্রোতাদের মধ্যে অনেকে আবার বলতে শুরু করেছে, তোমাদের ধর্মীয় কিতাব তো কুরআন-হাদীস নয়, ফিক্হ। তোমরা আসলে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উম্মতও নও, আবু হানিফার (রা.) উম্মত। ওই সেই ‘বাবু যাহা বলে পরিষদ দলে বলে তার শতগুণ’। অনেকে বলেন, অমুক মিডিয়ার, অমুক হুজুর বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা হাদীস জানতেন না, কেউ কেউ বলছেন, তিনি মাত্র ১২ খানা হাদীস জানতেন। কাজেই কুরআন-হাদীস বাদ দিয়ে যারা তার মাজহাবের অনুসরণ করবে তারা আল্লাহ্-রাসূলকে পাবে না। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। কী মারাত্মক কথা! কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া! সাধারণ মানুষদের এমন সব কথা বলার জন্য পরোক্ষভাবে প্ররোচিত করল কারা? আলেম-উলামাদের প্রতি এই অবিশ্বাস-অনাস্থা সৃষ্টি করার জন্য দায়ী কারা? এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তবে তার পরিণতি কোথায় গিয়ে গড়াবে! চরমপন্থী, উগ্রপন্থী লোক বিভিন্ন মতের অনুসারীদের মধ্যে থাকে। তারা যদি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, যদি সংঘাতে লিপ্ত হয় তবে পাকিস্তানের মতো আত্মঘাতী লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কি উড়িয়ে দেয়া যায়?
ওরা প্রচার চালাচ্ছে তোমাদের নামাজ মুহাম্মদী নামাজ নয়, হানাফী নামাজ। হানাফী আর মুহাম্মদী নামাজে নামাজকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে তারা। এদেশে মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ লোক সুন্নী হানাফী। হানাফী উস্তাদই বাল্যকালে নামাজ শিখিয়েছেন তাদেরকে। নিম্ন শ্রেণী থেকে সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত সকল মাদরাসায় হানাফী ফিক্হ পাঠ্য তালিকাভূক্ত। পীর মাশায়েখ, ওয়ায়েজ, মুবাল্লিগ, আলেম-উলামা, মাদরাসার উস্তাদগণ প্রায় সবাই হানাফী। তারা সবাই কি হাদীসের বিপরীত ভুল নামাজের তালীম দিয়েছেন? বিভিন্ন মাসআলা শিক্ষা দিচ্ছেন? ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, সমরখন্দ, বোখারা, দাঘিস্তান, চেচনিয়া, ইঙ্গুশতিয়া, খোতওয়ান, তুরস্কের প্রায় সব মুসলমান হানাফী ফিক্হে অনুসারী। আরব জাহান, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলমানদের মধ্যেও হানাফী ফিক্হের অনুসারীর সংখ্যা কম নয়। হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে বিশ্বের সহস্র সহস্র মুহাদ্দিস, মুফাসসীর, ফকিহ, ইমাম, উলামায়ে দ্বীন অনুসরণ করে আসছেন যে ফিক্হের, যে ইমামে আজমের, সেই ইমামই ছিলেন হাদীস শাস্ত্রে অজ্ঞ! উনারা প্রতিদিন প্রচার করে যাচ্ছেন, সাজানো প্রশ্নকর্তার প্রহসনমূলক প্রশ্নের উত্তরে বলে যাচ্ছেন ইমামের পিছনে মুক্তাদি কেরাত তথা সূরা ফাতিহা না পড়লে নামাজই হবে না, অর্থাৎ নামাজ পড়া সত্ত্বেও হবে বেনামাজি, এর চেয়ে চরম ধৃষ্টতা আর কী হতে পারে! ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা, কেরাত পড়ার যেমন হাদীস আছে তেমনি না পড়ারও হাদীস আছে, বিশিষ্ট সাহাবীগণের আমল উভয় দিকেই আছে, রাসূলে পাক (সা.)-এর জমানা হতে আজ পর্যন্ত দু’ধরনের আমলই জারি আছে। ফকিহ সাহাবীদের, তাবেঈন, তাবেতাবেঈন, ইমাম মুজহাতিদদের নামাজ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার, বাতিল অশুদ্ধ বলে অপপ্রচার চালানোর অধিকার কোথা থেকে পেলেন তারা? নিজেদের সুবিধামত হাদীসটিই তারা বলেন ইমামের পিছনে মুক্তাদীদের ফাতিহা, কেরাত না পড়ার, রাফে ইয়াদাইন না করার, আমীন জোরে না বলার অসংখ্য হাদীস রয়েছে তার উল্লেখ করেন না ভুলক্রমেও। সে হাদীস সমূহ অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করে এই যে অপপ্রচার চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা কোন ধরনের দ্বীনি খিদমত? যারা বেনামাজি তাদের নামাজি বানানোই তো ছিল দায়িত্ব, যারা নামাজ পড়ছেন তাদের সংশয়ে, সন্দেহে নিক্ষেপ করা তো দ্বীনি খিদমত হতে পারে না। বাংলাদেশের শত সহস্র মাদরাসার উচ্চ শ্রেণীসমূহে যেমন ফিক্হ পড়ানো হয় তেমনি অত্যন্ত শুরুত্বের সাথে সহীহ হাদীসের গ্রন্থসমূহ, সিহাহ্ সিত্তাহ ও অন্য হাদীস গ্রন্থ পড়ানো হয়। তাই উনারাই হাদীসবেত্তা অন্যরা হাদীস পড়ে না, জানে না, আমল করে না এমনটা ভাবা আহাম্মুকী বৈ কিছুই নয়।
ইসলামী জ্ঞান, আইন, শরীয়তের মূল উৎসই কুরআন ও হাদীস। কুরআন ও হাদীস উভয়ই ওহী। একটি ওহীয়ে মতলু আর একটি ওহীয়ে গায়ের মতলু। হাদীসকে বাদ দিলে দ্বীনের অস্তিত্বই থাকে না। তাই সকল আলেমেদ্বীনই হাদীস মানেন, হাদীস জানেন এবং হাদীস মোতাবেকই আমল করেন। হাদীস কারোর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, সকল মুসলমানই আহলে কুরআন, সকল মুসলমানই আহলে হাদীস। কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রামাণিত, প্রিয় নবীর (সা.) আমলে সাহাবী, তাবেঈনদের মাধ্যমে পরস্পরায় প্রাপ্ত, ইজমায়ে উম্মাহর দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সর্বসম্মত মাসআলা যেন তেন শাজ মুনকার হাদীস আউড়িয়ে উড়িয়ে দিয়ে যে কাজটি করা হচ্ছে তারই নাম ফিতনা। এ ফিতনা সৃষ্টি থেকে, ভ্রান্তবিচ্যুত রেওয়ায়েত পেশ করে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপতৎপরতা থেকে তাদের এখনই বিরত হওয়া আবশ্যক। আমাদের আহবান, বিরত হোন। হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াবেন না, আপনি ও আপনার অনুগামী অনুসারী ছাড়া অন্য সবাই ভ্রান্ত, এমন দাম্ভিক উক্তি ও প্রচারণার ফল কখনই ভালো হতে পারে না।
ইসলামের পথ সংকীর্ণ নয়, কণ্টকিত নয়, প্রশস্ত ও মসৃণ। ইলমে হাদীসের পরিসরও বিশাল। তারপরও যুগের আবর্তনে সৃষ্ট নিত্য নতুন সমস্যার সমাধানে ইজমা ও কিয়াসের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ইমাম ও মুজতাহিদগণ কুরআন, হাদীসের ভান্ডার সামনে রেখে, ইজমায়ে উম্মত ও কিয়াসের ভিত্তিতে চলার পথ সুগম করার জন্য ইসলামী আইন-কানুন বিধি-বিধানের যে সুবিন্যস্ত শাস্ত্র উম্মতকে উপহার দিয়েছেন তারই নাম ফিকহ। যারা ফিকহের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন তারাও নামাজ শিখেছেন ফিকাহ্ থেকেই। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা আবদুল মালিকের ‘নবীজির নামাজ’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখা বক্তব্যটি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : ‘যদি অমুসলিমকে ইসলাম গ্রহণের পরে এবং শিশুকে বালিগ হওয়ার পর বাধ্য করা হতো যে, তোমাদেরকে নামাজ আদায়ের পদ্ধতি হাদীসের কিতাব থেকে শিখতে হবে, কারো তাকলীদ করতে পারবে না, দলিল প্রমাণের আলোকে সকল বিষয় নিজে পরীক্ষা করে নামাজ পড়বে। তাহলে বছরের পর বছর অতিবাহিত হবে কিন্তু নামাজ পড়ার সুযোগ হবে না। একই অবস্থা হবে যদি সাধারণ মানুষকে এই আদেশ করা হয়। খুব ভালো করে বুঝে নেয়া প্রয়োজন যে, কুতুবে সিত্তা বুখারী, মুসলিম, আবুদাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থের সংকলক ইমামগণও প্রথমে নামাজ শিখেছেন ফিকহে ইসলামী থেকেই।’ ‘গোটা নামাজের পদ্ধতি ধারাবাহিকভাবে কোন এক হাদীসে নেই। পূর্ণ নামাজের ধারাবাহিক নিয়ম হাদীসের এক-দুই কিতাব নয়, ছয় বা দশ কিতাবেও বিদ্যমান নেই।’ নামাজের পদ্ধতি শুধু মৌখিক আলোচনার মধ্য দিয়ে শেখা যায় না। সঠিক পদ্ধতিতে সহিহ শুদ্ধভাবে নামাজ আদায় করা শিখতে হয় নামাজ আদায়কারীর নামাজ দেখে। সাহাবায়ে কেরাম শিখেছেন নবীজি (সা.)-এর নামাজ দেখে। তাবেয়ীরা শিখেছেন সাহাবায়ে কেরামের নামাজ দেখে। এভাবে যুগ পরম্পরায় চলে এসেছে আজ পর্যন্ত। আবার সাহাবায়ে কেরামের দেখা ও শেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। বিজ্ঞতায় প্রজ্ঞায় মর্যাদায় তাদের সবাই এক সমান যেমন ছিলেন না তেমনি সর্বক্ষণ নবীজির সঙ্গে থেকে নামাজ আদায় করার সৌভাগ্য লাভ করেননি অনেকেই? আলোচনার সময় এসব তুলে ধরা দরকার। পক্ষের বিপক্ষের সব দলিলই পেশ করা দরকার। কিন্তু বিভিন্ন চ্যানেলে ধর্মীয় প্রশ্নোত্তর পর্বে মতলববাজদের দেখা যায়, কেবল নিজের গরজেরটাই বলে যান অন্য রেওয়ায়েত যে আছে তার ধারও ধারেন না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেদিন এক টিভি চ্যানেলে জনৈক উত্তরদাতাকে প্রশ্নোত্তরে বলতে শুনলাম : তাকবীর তাহরিমা ছাড়া নামাজের অন্য কিছু তাকবীরে রফয়ে ইয়াদাইন করতে হবে। এটাই সুন্নত তরিকা। এটা আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর হাদীস থেকে প্রমাণিত। কিন্তু হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)-এর পিতা দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রা), ৪র্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ), (নবীজির পরিবারের আহলে বাইতের সাথে দীর্ঘকাল ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করার জন্য অনেকে যাকে আহলে বাইতের সদস্য বলে ধারণা করতেন সেই) উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের এক বিরাট দল যে তাকবীর তাহরিমা ছাড়া রফয়ে ইয়াদাইন করতেন না এসব হাদীসের ধারেকাছেও গেলেন না। ইমামের পিছনে মুক্তাদির সূরা ফাতিহা কেরাত না পড়া, রফয়ে ইয়াদাইন না করা, আমীন জোরে না বলা ইত্যাদি হানাফীদের আমলগুলোও যে সুন্নতসম্মত, এর সমর্থনেও যে অনেক সহীহ্ হাদীস রয়েছে মতলববাজ মুফতীরা তার উল্লেখ তো করেনই না বরং হানাফীদের নামাজের সাথে নবী (সা.)-এর নামাজের মিল নেই, সম্পর্ক নেই এমন কথাই তাদের বলতে শোনা যায়। আসলে, উদ্দেশ্য তাদের সহীহ মাসয়ালা শেখানো নয়, উদ্দেশ্য উম্মাহ্র মধ্যে অনৈক্য, বিশৃঙ্খলা, ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা।
এ অবস্থায় হানাফী উলামাদের এ ফিতনা-ফাসাদের মোকাবেলায় অগ্রসর হওয়া উচিত। মতলববাজরা যেসব আমলকে শিরক-বিদাত, হাদীসবিরোধী, ভিত্তিহীন, বাতিল বলে অপপ্রচার চালাছে তার মোকাবেলায় দলীল প্রমাণ তুলে ধরা দরকার। কুরআন সুন্নার মজবুত ভিত্তির ওপর যে এ মাজহাব প্রতিষ্ঠিত মসজিদে মসজিদে, মাহফিলে মাহফিলে তা পেশ করা অবশ্যক। যেটা শিরক, যেটা ঘৃণিত বিদাত যেটা ইসলাম গর্হিত কুসংস্কার অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে হবে। কিন্তু যেটা সুন্নাত সমর্থিত, যেসব মাসআলা দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং যে এলাকার লোক এমন সহীহ মাসয়ালার ওপর আমল করে সেখানে অন্যমত থাকলেও তা অতি উৎসাহে প্রচারণা না করাই নিয়ম। এর দ্বারা কেবল আওয়ামের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
ইসলামী আইনের মূল উৎস কুরআন-হাদীস হওয়া সত্ত্বেও তা অভীক্ষ অবেক্ষণে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য হওয়া স্বাভাবিক। এজন্য কিছু কিছু শাখা মাসায়লে ইখতিলাফ হওয়া, থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা হয়ে আসছে, হতে থাকবে। ইখতিলাফ বা মতপার্থক্যতে দোষণীয় কিছু নেই। দোষ হচ্ছে ইখতিলাফকে মুখালাফাতে পরিণত করায়। দোষ হচ্ছে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াসের দলীলে সমৃদ্ধ মাসআলা মাসায়িল, যার ওপরে এদেশের প্রায় সব মুসলমানের আমল জারি রয়েছে সেগুলোকে বেআসল, বেবুনিয়াদ বলে মিথ্যা প্রচারণায়। দোষ হচ্ছে মসনুন বিষয়গুলোকে শিরক বিদাত, মনগড়া, বানোয়াট আখ্যায়িত করায়। এসব কাজ ধ্বংসাত্মক।
বাংলাদেশের মানুষ ধর্মীয় ব্যাপারে সহিষ্ণু। বাংলাদেশের মানুষ উলামা-মাশায়েখদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাদের সাথে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষ যুগপরস্পরায়, বংশপরস্পরায় পরম আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে নির্বিঘ্নে নিরুপদ্রবে হানাফী মাজহাব অনুসরণ করে নামাজ, রোজা, ইবাদত বন্দেগী করে আসছে। এই স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ বিনষ্ট করার অপপ্রয়াসে যারা লিপ্ত হয়েছে, সংশয় সন্দেহ অবিশ্বাস অনাস্থার বীজ যারা বপন করে চলছে তারা কাদের প্রয়োজন পূরণ করছে? দেশকে ধর্মীয় সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যারা তাদের মতলব কি? উদ্দেশ্য কি? স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, হাজার হাজার মুহাক্কিক আলেমকে সুকৌশলে ভ্রান্ত ও বিদাতী বলার দুঃসাহস, কোটি কোটি মুসলমানের সহীহ শুদ্ধ নামাজকে অশুদ্ধ বলার ধৃষ্টতা, সুন্নাত তরিকা অনুযায়ী তাদের আকিদা আমলকে শিরক বিদাত ও বাতিল বলে অপপ্রচার চালানোর ঔদ্ধত্য উনারা পেলেন কোত্থেকে? কোন্ খুঁটির জোরে তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতিদিন হেনে চলছে আঘাতের পর আঘাত? তা নির্ণীত হওয়া আবশ্যক। যে মুহূর্তে উম্মাহ্র ঐক্য সংহতি সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেই মুহূর্তে ফিতনা-ফাসাদের দ্বার যারা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে, সংঘাতের দিকে জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা আসলে কাদের লোক? এটা ভাববার সময় এসেছে। ফিতনা নয়, ফাসাদ নয়, কুরআন-হাদীসের দলীল-প্রমাণ দিয়ে তাদের মোকাবেলা করতে হবে।

সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, ৩ অক্টোবর, ২০১১ইং ঢাকা।
 2 0 0 0 21

- See more at: http://www.mashikdeendunia.com/?p=144#sthash.YzHfu0U4.dpuf

No comments:

Post a Comment