ইকামতে দ্বীন ও ফরয প্রতিষ্ঠা: ড. গালিবের অভিযোগ, আমাদের জবাব Ikamate Din

 


তানজিল ইসলাম

----------------------------
অধ্যাপক গোলাম আযম (রাহঃ) স্যার তাঁর 'ইকামতে দ্বীন' নামক বইয়ে 'ফরযের পজিশন' সম্পর্কে এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। তার সারকথা হল- কোনো দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা না থাকলে সে দেশে আল্লাহর নির্ধারিত 'ফরয' বিধান ফরযের পজিশনে থাকে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে তা সাধারণত মুবাহ অবস্থায় থাকে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ তিনি বলেন, "আল্লাহ পাক মুসলিমদের উপর পাঁচ ওয়াক্তের নামায সময় মত আদায় করা ফরয করেছেন। (সূরা বাকারাঃ২/৪৩, ১১০, ২৩৮; মায়িদাঃ৫/১২, ৫৫; তওবাহঃ৯/৫, ১১, ৭১; হজ্জঃ২২/৪১, আম্বিয়াঃ২১/৭৩; আহযাবঃ৩৪/৩৩; মরিয়মঃ১৯/৫৫; রূমঃ৩০/৩১; মুযযাম্মিলঃ৭৩/২০ ইত্যাতি) ফরয মানে হলো অবশ্য কর্তব্য বা অপরিহার্য দায়িত্ব। আল্লাহ নামাযকে ফরযের গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে নামাযের পজিশন কী? সাধারণভাবে এ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নামায মুবাহ অবস্থায় আছে। অর্থাৎ করলে ক্ষতি নেই এবং না করলেও দোষ নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে নামায পড়া মাকরূহ বা অপসন্দনীয়। পিয়ন জামায়াতে যেয়ে নামায পড়ে, বেনামাযী অফিসার এতে বিরক্ত হয়। কোথাও কোথাও নামায পড়া হারাম বা নিষিদ্ধ। ডিউটি থাকাকালে নামায কাযা করতে বাধ্য হতে হয়। দ্বীনে বাতিলের অধীনে নামাযের জন্য আল্লাহর দেয়া এ হুকুমের সাথে এরূপ ব্যবহার করাই স্বাভাবিক। যদি দ্বীনে হক এ দেশে কায়েম থাকতো তাহলে নামাযকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফরয হিসেবেই মর্যাদা দেয়া হতো। সর্বত্র সবাই যাতে নামায ঠিক মতো আদায় করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হতো। (ইকামতে দ্বীন, পৃঃ ২৫)
.
ড. গালিব জামায়াতের সমালোচনায় এ বক্তব্য বিকৃতি করে বলেন, "ছালাত-ছিয়ামের ফরয ইবাদতকেও এরা 'মুবাহ' বলে থাকে। যা আদায় করলে নেকী আছে, না করলে গুনাহ নেই। কারণ তাদের মতে সব ফরযের বড় ফরয হ'ল শাসনক্ষমতা দখল করা। সেটা না থাকায় তাদের মতে কোন ফরযই বাস্তবে ফরযের পজিশনে নেই। বরং মুবাহ অবস্থায় আছে।" (গালিব, জিহাদ ও ক্বিতাল, পৃঃ ৭৪-৭৫)
দেখুন, কত মারাত্মকভাবে গালিব স্যার গোলাম আযম (রাহঃ) স্যারের কথার ভ্রান্ত ব্যাখ্যা করেছেন, জামায়াত নাকি ফরয ইবাদতকে 'মুবাহ' বলে (নাউযুবিল্লাহ)! এখানে গোলাম আযম স্যার (রাহঃ) বলেছেন, আল্লাহর দ্বীন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত না থাকলে তথা রাষ্ট্রে আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানবরচিত কুফুরী আইন কার্যকর থাকলে সে দেশে নামায রোযার মত ফরয ইবাদতও রাষ্ট্রীয়ভাবে আবশ্যক তথা ফরযের মর্যাদা পায় না বরং তা সাধারণত 'মুবাহ' তথা ঐচ্ছিক অবস্থায় থাকে। আর তিনি যা বলেছেন তা ১০০% সঠিক কথা। বর্তমানে আমাদের দেশে নামায রোযা আদায় করা সাধারণত রাষ্ট্রীয়ভাবে আবশ্যক (ফরয) তথা বাধ্যতামূলক না বরং 'মুবাহ' তথা ঐচ্ছিক। আদায় করা, না করাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন বাধানিষেধ নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে নামায পড়া মাকরূহ বা অপসন্দনীয়। আবার কোথাও কোথাও নামায পড়া হারাম বা নিষিদ্ধ। অনার্স মাস্টার্স ৪ ঘণ্টা পরীক্ষায় আমার মত হাজার হাজার ছাত্রের জন্য সময় মত পড়া নিষিদ্ধ ছিল। বাধ্য হয়ে নামায কাযা করতে হয়েছে। এই তো কয়েক দিন আগের কথা, আমার মসজিদের এক মুসল্লি যে প্রায় বছর খানেক আগে সেনাবাহিনীর চকুরীতে যোগ দিয়েছে, সে আমার কাছে মাসয়ালা জানার জন্য জুমার দিন ফোন করে সালাম দিয়ে বলল, "হুজুর! দুপুর ১২টা থেকে সন্ধা ৬টা পর্যন্ত আমি এক বিশেষ ট্রেনিং -এ আছি। আর এ ট্রেনিং আরো কয়েক সপ্তাহ চলবে। এখানে আমাদের জুমার নামায আদায় করতে মসজিদে যেতে দিচ্ছে না। ফলে আমি সময় মত নামায আদায় করতে পারছি না। নামায কাযা করলেও কি এতে আমার গুনাহ হবে?" জবাবে আমি বলেছি, আল্লাহ তোমার ওজর গ্রহণ করলে তুমি গুনাহর হবে না। তবে যারা রাষ্ট্রে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে কুফুরী বিধান জারী রেখেছে তারা ও তাদের দালাল দরবারী আলেমরা গুনাহগার হবে নিশ্চয়।
.
এখন বলুন তো, যদি এ দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর দ্বীন কায়েম থাকতো তাহলে কি সময় মত নামায পড়তে বাধা দেওয়া হত? না কি নামাযকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফরয হিসেবেই মর্যাদা দেয়া হত? শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ
ان ولاية امر الناس اعظم واجبات الدين بل لاقيام للدين الا بها ولان الله تعالي اوجب الامر بالمعروف و النهي عن المنكر ولايتم ذلك الا بقوة وإمارة ونصرة المظلوم وكذلك ساءر ما اوجبه من الجهاد والعدل واقامة الحدود لا تتم الا بالقوة والامارة.
"জনগণের যাবতীয় ব্যাপার সুসম্পন্ন করা তথা শাসন-ব্যবস্থা কায়েম করা দ্বীনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয় বরং শাসন-ব্যবস্থা (রাষ্ট্র) এমন এক অপরিহার্যতা যা ছাড়া দ্বীন প্রতিষ্ঠা হতেই পারে না। কেননা আল্লাহ তা'য়ালা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং মজলুমদের সাহায্য করা ফরয করে দিয়েছেন। এসব ওয়াজিব পালন রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থা ছাড়া সম্ভব নয়। এ ভাবে তিনি জিহাদ, ইনসাফ ও আইন-শাসন প্রভৃতি যেসব কাজ ফরয করে দিয়েছেন তা রাষ্ট্রশক্তি ও শাসন-ব্যবস্থা ছাড়া কিছুতেই সম্পন্ন হতে পারে না।" (আস-সিয়াসাতুশ শরইয়্যাহ, শরীয়াহর নীতি, পৃষ্ঠাঃ ১৬১-১৬২)
.
তাই তো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে আল্লাহ তা'য়ালা নির্দেশ দিয়ে বলেন,
وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا.
(হে রাসূল) বল, ‘হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করাও উত্তমভাবে এবং বের কর উত্তমভাবে। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাকে সাহায্যকারী (রাষ্ট্র)শক্তি দান কর’।
(সূরা বানী ইসলাঈল: ১৭/৮০)
এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর রাহঃ বলেন, "আল্লাহ তা'য়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, বিজয় লাভ ও সাহায্যের জন্য আমার নিকট প্রার্থনা কর। এই প্রার্থনার কারণে আল্লাহ তা'য়ালা পারস্য ও রোম রাষ্ট্র বিজয় এবং সম্মান প্রদানের ওয়াদা করেন। এটাতো রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানতেই পেেরছিলেন যে,
أن لا طاقة له بهذا الأمر إلا بسلطان، فسأل سلطانا نصيرا لكتاب الله، ولحدود الله، ولفرائض الله، ولإقامة دين الله-
রাষ্ট্রীয় বিজয় লাভ ছাড়া দ্বীনের প্রসার ও শক্তিলাভ সম্ভবপর নয়। এ জন্যই তিনি আল্লাহর নিকট সাহায্য ও রাষ্ট্রীয় বিজয় কামনা করেছিলেন, যাতে তিনি আল্লাহর কিতাব, আল্লাহর আইন, (ولفرائض الله) আল্লাহর ফরযসমূহ এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।" (তাফসীরে ইবনে কাসীর)।
.
ইমাম ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে কাসীর রাহঃ এর আলোচনা থেকেও প্রমাণিত হল যে, আল্লাহর ফরযসমূহ ফরয হিসাবে তথা আবশ্যক ও বাধ্যতামূলক ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রীয় বিজয় অর্জন করা অপরিহার্য। আর আহলে হাদীসের আমীর ড. গালিব এ কাজকে 'শাসনক্ষমতা দখল' বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আল্লাহর বিধানের সাথে ব্যঙ্গ করলেন। বস্তুতঃ দুনিয়ার স্বার্থে গালিব সাহেবরা চান যে, বংশানুক্রমিক ভাবে 'শাসনক্ষমতা' তাদের প্রভূরা হাতে রেখে কুফুরী বিধান জারী রাখুক। তাদের প্রভূদের হাত থেকে যেন কেউ শাসনক্ষমতা দখল করে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, এ বিষয়ে তাদের অন্ধভক্তদের সবক দেয় ও ভ্রান্ত ফতোয়া দিয়ে সাধারণত জনগণকে বিভ্রান্ত করে। কিন্তু সে সবক অন্ধভক্তগণ গিললেও সবাই কি খাবে?

No comments:

Post a Comment